শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি রুহুল আমিন পলাতক রয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। তবে তিনি অসুস্থ বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে মুফতি রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বার্তা২৪.কমের প্রতিনিধি। তিনি জানান, গত ১৯ জুলাই থেকে তিনি অসুস্থ। ওই দিন থেকেই আর নামাজ পড়াতে যাননি।
এক প্রশ্নের জবাবে মুফতি রুহুল আমিন বলেন, আমি আত্মগোপন কিংবা পলাতক থাকবো কেনো। আমার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না করেই বিভিন্ন গণমাধ্যম এ ধরনের তথ্য পরিবেশন করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার।
বায়তুল মোকাররমে কবে থেকে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন জানতে চাইলে মুফতি রুহুল আমিন বলেন, ২০২২ সালের ৩১ মার্চ আমাকে খতিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই বছর পাঁচ মাস যাবত আমি খতিবের দায়িত্বে আছি।
সরকার পতনের পর বেশ কয়েক জুমায় অনুপস্থিত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি অনুপস্থিত। ফুসফুসে প্রদাহজণিত অসুবিধার পাশাপাশি এজমা-এলার্জিতে আক্রান্ত। এ কারণে প্রায়ই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তখন কথা বলতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। অসুস্থতা বিষয়টি প্রথমে কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে এবং পরে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
সরকার পরিবর্তনে আমি অনুপস্থিত একথা ভিত্তিহীন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিন্তু বলেননি আমি আত্মগোপনে কিংবা পলাতক। সরকারের ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা, ধর্ম সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকসহ দায়িত্বশীল কারও কাছে থেকে এমন কোনো কথা বলা হয়নি, আসারও কথা নয়। কারণ এই জায়গার সঙ্গে পালানো ও আত্মগোপন এসব কথা হাস্যকর, উদ্দেশ্যমূলক এবং উসকানিমূলকও বটে। হ্যাঁ, নামাজ পড়াতে না যাওয়ার কথা আসতে পারে। কিন্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্তৃপক্ষ থেকে কিন্তু কেউ বলেনি, আমার সঙ্গে কথা হচ্ছে না। আমার ড্রাইভার, খাদেম বা কর্তৃপক্ষ- যাদের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ থাকে তারা তো বলেনি, তাহলে অন্যরা একথা বলে কিভাবে?
এখানে বায়তুল মোকাররমের নামাজ পড়ানোর বিষয় না। আমি হাজার হাজার কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিত্ব করি, লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক সেখানে রয়েছে। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ পরিষদ হাইয়াতুল উলইয়ার ৩২ জনের মধ্যে আমিও দায়িত্ব পালন করছি। আমার বাবার ১০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রেখে যাওয়া কাজ ও সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। আসলে এ জাতীয় কথা প্রচার করা হচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে।
সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম অভিযোগ করেছেন যে, তারা বিগত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে নিয়ে দোয়া চাওয়ার জন্য বায়তুল মোকাররমে যায়, আপনি তাদের জন্য দোয়া করেন নাই বরং ধর্মমন্ত্রীকে ডেকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে মুফতি রুহুল আমিন বলেন, দেখুন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে ২০২০ সালে, আর আমাকে খতিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০২২ সালের ৩১ মার্চ। সুতরাং ঘটনার সময় আমি দায়িত্ব পালন করিনি। তখন যারা নামাজ পড়িয়েছেন বা দায়িত্বে ছিলেন, তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।
খতিব হিসেবে আপনার দায়িত্ব পালন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, আপনি বিষয়টা কিভাবে দেখছেন প্রশ্ন করা হলে মুফতি রুহুল আমিন বলেন খতিব হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন নিয়ে বিপক্ষের মানুষ বেশি দেখছি না। যারা বলছে, তারা না বুঝে বলছে। তবে আমি শুধু দেখব কওমি উলামায়ে কেরাম কি বলছেন, যাদের প্রতিনিধিত্ব আমি করি, তাদের গঠনমূলক সমালোচনা আমার সংশোধনের জন্য সহায়ক। এ ছাড়া সমালোচনা সবক্ষেত্রে, সবার ক্ষেত্রে থাকবে- এটা খুবই স্বাভাবিক।
অনেকেই বলছেন, আপনাকে বির্তকিত করার বিষয়ে বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, আপনিও কি এমন মনে করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এখনও আমি তাদের কাছ থেকে এমন কোনো আচরণ পাইনি। তাদের সংশ্লিষ্টতা আমি দেখছি না।
বিতর্ক যদি বাড়ে, তাহলে আপনি কি করবেন প্রশ্ন করা হলে মুফতি রুহুল আমিন বলেন, এখনও আমি এটা নিয়ে সেভাবে চিন্তা করিনি। আমি চিকিৎসা নিচ্ছি। তবে বায়তুল মোকাররমের খতিব পদের একটা রীতি আছে, তাহলো- কাউকে নিয়োগ দেওয়ার পর আমৃত্য তিনি খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। এটাই বায়তুল মোকাররমের ঐতিহ্য।
এমতাবস্থায় যদি এই প্র্যাকটিস শুরু হয় যে, খতিব পদত্যাগ করছে, খতিবকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দের ব্যক্তিদের বসানো-সরানো হচ্ছে। শরয়ি কোনো কারণ ছাড়া খতিব পরিবর্তনের প্র্যাকটিস যদি শুরু হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটা আরও খারাপ হবে বলে মনে করি। কখন কে খতিব থাকল, এটা বিষয় না। খতিবের মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্র্যাকটিসটা চালু হলে, ভবিষ্যতে কোনো খতিব তার জীবনের শেষ অধ্যায় ইজ্জত-সম্মানের সঙ্গে শেষ করতে পারবে না সুতরাং আমি এই দ্বার উন্মোচন করার পক্ষে নই। একজন খতিব শরিয়তের পরিপন্থী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদার পরিপন্থী কিনা এটাই হলো- লক্ষণীয়।
খতিবের দায়িত্ব সরে যাবেন কিনা জানতে চাইলে মুফতি রুহুল আমিন বলেন, বায়তুল মোকাররমের খেদমত ছাড়াও আল্লাহতায়ালা আমাকে দ্বীনের আরও বহুবিধ খেদমতের সুযোগ করে দিয়েছেন- আলহামদুলিল্লাহ। যারা জানার তারা জানেন, বিষয়টি হচ্ছে- আমি এই মিম্বরে কওমি আলেমদের প্রতিনিধিত্ব করি। আপনি মনে করে দেখবেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর পুরো কওমি অঙ্গন থেকে আমাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ সংস্থা হাইয়াতুল উইলয়া কর্তৃপক্ষ অভিনন্দন জানিয়েছেন, দোয়া করেছেন।
বর্তমানে আমার বিষয়ে আপত্তিকর যা কিছু উপস্থাপন করা হচ্ছে, সবকিছুই খতিব হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগের কথা। মসজিদের মিম্বরকে আমি সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখেছি। এখান থেকে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছে বলে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না।
শেখ হাসিনাকে আপনি কওমি জননী উপাধি দিয়েছিলেন এ বিষয়ে কি বলবেন- মুফতি রুহুল আমিন বলেন, হ্যাঁ, এটা আমার বক্তব্যের মধ্যে এসেছে, তা অস্বীকার করবো না। ২০১৭ সালে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির জন্য ‘শুকরানা মাহফিল’-এর আয়োজন করা হয়। কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রেক্ষিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর জন্য, অর্থাৎ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।
কথা হলো, ‘শুকরানা মাহফিল’ নামে এমন সেকেলে মাহফিল না করলেও হতো। শীর্ষ আলেমরা গিয়ে এই কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানালেই পারত। কিন্তু এই নামে মাহফিলের পরিকল্পনা কারা করেছেন, কিংবা এমন আয়োজন করতে কোনো চাপ ছিলো কি-না; সেই বিষয়টা আমাদের দেখা দরকার। যাহোক, আলেমদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপরে দ্বিমত করছি না। সেই প্রোগ্রামে যখন বক্তব্য শুরু করি, তখনও এই বিষয়টি আমার মাথায় ছিল না। অপরিকল্পিতভাবে হঠাৎ করে আমার বক্তব্যে কওমি জননী শব্দটা চলে আসে। সবাই নিজ নিজ বক্তেব্যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে, সেই ধারাবাহিকতায় আমি বলেছি।
কওমি সনদের স্বীকৃতির জন্য এবং কওমি আলেমদের কথাটা বলেছি। তারা যদি মনে করেন, কথাটা অতিরিক্ত; তাহলে অবশ্যই এটা অতিরিক্ত। তারা যেটাকে বিতর্কিত মনে করবেন সেটা অবশ্যই বিতর্কিত। এটা নিয়ে সাফাই পেশ করার বা স্টাবলিশ করার প্রশ্নই আসে না।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সামনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল বানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ম্যুরাল স্থাপনের বিষয়টি যারা দায়িত্বশীল আছেন, তারা ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু এতটুকু বলতে চাই, একজন দেওবন্দি আলেম, কওমি মাদরাসার আলেম- তিনি যে স্তরেরই হোন না কেন, ম্যুরাল বা ভাস্কর্য স্থাপনের বিষয়ে একাত্মতা পোষণ করবেন- এটা হতে পারে না।
মুফতি রুহুল আমিন বলেন, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, এটা আমরা বলি; কাগজপত্রেও লেখা হয়। কিন্তু অফিসিয়ালি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ কি-না এটা খতিয়ে দেখা দরকার। আমার জানামতে, এটা জাতীয় মসজিদ না। তথ্যটা অনেকেই জানে না। মসজিদটি যদি জাতীয় মসজিদের স্বীকৃতি না হয়ে থাকে, তাহলে এই দাবিটা সামনে আসা দরকার।
এ ছাড়া বায়তুল মোকাররমের পরিচর্যা, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য- রাষ্ট্রের সব স্থাপনা থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এটা ইসলামের মর্যাদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট- খতিব, ইমাম, মোয়াজ্জিন ও খাদেমসহ সবাইকে সে অনুযায়ী মর্যাদা দেওয়া উচিত।
শেষ কথা হলো, খতিব যেই হোক না কেন- তার সম্মান থাকবে সবার ওপরে। তিনি সত্য উচ্চারণে কোনো কিছুর পরোয়া করবেন না। খাতিবকে যদি এই সম্মান দেওয়া হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম সম্মানিত হবে।