ইউরোপের মধ্যে অস্ট্রিয়া একটি ব্যতিক্রমধর্মী দেশ। যেখানে ১৯১২ সাল থেকে ইসলাম অস্ট্রিয়ায় সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত একটি ধর্ম। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র হয়েও অস্ট্রিয়া ১৯১২ সালে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে (তখন) বসবাসকারী কয়েক হাজার মুসলিমকে দেশের নাগরিকত্বে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
উসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক ১৪৬৩ সাল থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত শাসিত ও ১৯০৮ পর্যন্ত অটোমান অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে ১৯০৮ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য (১৮৬৭ থেকে ১৯১৮) তাদের অধীনে সংযুক্ত করে।
অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের এই অঞ্চলে ৬ লাখ মুসলমান বাস করতো, যাদের ধর্মীয় অনুশীলনকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় বসনিয়ান মুসলমানরা সম্রাটের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করতেন, ইমামরা সামরিক চ্যাপ্লেন (ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক নেতা) হিসেবে কাজ করতেন। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশীলন রক্ষা সংক্রান্ত উদ্বেগটি ১৮৭৪ সালে সম্পাদিত স্বীকৃতি আইন। ১৮৭৪ যা ধর্মীয় সমাজের আইনি স্বীকৃতি মোতাবেক ১৯১২ সালে অস্ট্রিয়ায় ইসলাম আইনি স্বীকৃতি পায়।
১৯৭১ সালে মুসলমানদের একটি সংস্থা ‘ইসলামি আইন ১৯১২’-এর ধারা মোতাবেক একটি ইসলামিক কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আবেদন করলে, ১৯৭৯ সালে ‘ইসলামিক রিলিজিয়াস অথরিটি ইন অস্ট্রিয়া’ পাবলিক আইনের অধীনে একটি কর্পোরেশন হিসেবে গঠিত হয়।
সংস্থাটি ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষকদের মাধ্যমে দেশটিতে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্তা, ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের চলমান প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করাসহ মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহুবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে এটি অস্ট্রিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ের সরকারি প্রশাসনের প্রতিনিধিত্বকারী সর্ববৃহৎ সংস্থা।
এই সংগঠনের ধারাবাহিক তৎপরতায় ২০১৫ সালে অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট ইসলামি আইন-১৯১২ তে সংশোধনী এনে অস্ট্রিয়ায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, এমন করে ইসলাম বিকাশের সুযোগ সম্প্রসারিত করে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য মুসলিম অধ্যুষিত বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা দখল করে নিলে সেখানকার মুসলিম অধিবাসীরা খ্রিস্টানদের শাসনের অধীনে চলে আসে। এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হলে মুসলিমরা ব্যাপকভাবে নিজ নিজ দেশে ফিরে যায় এবং মাত্র কয়েক শ’ মুসলমান অস্ট্রিয়ায় বসবাস করতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইসলামিক ল’ অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
এর পর বেশ কয়েক বছর মুসলিম নেতারা সরকারের কাছে দেন-দরবার করেন আইনটিতে সংশোধনীর। প্রয়োজনীয় আইনের সুরক্ষা না থাকায় অস্ট্রিয়ায় মুসলিমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকরূপে বসবাস করছিল। তাদের দাবি পূরণে ২০১৫ সালে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে আইনটিকে যুগোপযোগী করা হয়।
আইনের সংশোধনীতে ইসলামের সরকারি স্ট্যাটাস নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুসলিমদের অধিকারগুলো সম্প্রসারিত করা হয়। এর ফলে ইসলামি আচার-আচরণ কিংবা মুসলিম উৎসব পালনের জন্য মুসলিমরা কর্মস্থল থেকে ছুটি নিতে পারছেন। এই আইনবলে হাসপাতালে, কারাগারে এবং সশস্ত্রবাহিনীতে অবস্থানকালে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অনুশাসন পালন এবং হালাল খাবারের অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। সংশোধিত আইনে ইমাম প্রশিক্ষণের জন্য ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইসলামি অধ্যয়ন প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে।
সংশোধনীতে অস্ট্রিয়ার কোনো ইসলামি গ্রুপের দেশের বাইরে থেকে অর্থায়ন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি অস্ট্রিয়ার কোনো মসজিদে বিদেশি ইসলামি ধর্মনেতার নেতৃত্ব প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সব ইমামকে জার্মান ভাষায় কথা বলা এবং ইমামদের ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি প্রোগ্রাম থেকে উত্তীর্ণ হয়ে অথবা সমমানের অন্যকোনো প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হয়ে তাদের ‘পেশাগত যোগ্যতা’ প্রমাণ করতে হবে।
বর্তমানে অস্ট্রিয়ায় রোমান ক্যাথলিকদের পরেই ইসলাম হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রিয়ার মুসলমানরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তা সত্ত্বেও এগিয়ে চলছেন মুসলমানরা।
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অবস্থিত বিখ্যাত দানিউব নদী। এই নদীর পাড়েই ভিয়েনা ইসলামিক সেন্টার ও মসজিদের অবস্থান। একটি মিনার ও সবুজ রঙের এক গম্বুজের মসজিদটি দেখতে বেশ সুন্দর। বিশাল গম্বুজের নিচে মূল নামাজের স্থান।
মসজিদের সামনে রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, পাশে ওজুর ব্যবস্থা। পেছন দিকে শিশুদের খেলাধুলার স্থান। রয়েছে নারীদের জন্য প্রবেশের আলাদা পথ। পুরো মেঝেতে কার্পেট পাতা, সাজানো-গোছানো সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। বারান্দায় আলমারিতে বিভিন্ন ইসলামিক বইপত্র সাজানো আছে। বাঁ-পাশে আলাদা কক্ষ।
১৯৬৮ সালে একটি মসজিদ তৈরির জন্য অস্ট্রিয়া সরকারের সহায়তায় দানিউব নদীর কাছে ৮ হাজার ৬০০ বর্গমিটার জমি ক্রয় করে আটটি ইসলামিক রাষ্ট্র। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে এর নির্মাণ কাজ শুরু হতে বিলম্ব হয়। পরে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আর্থিক সহায়তায় ১৯৭৭ সালের ১ জুলাই মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দুই বছরের বেশি সময়ে এটি সম্পন্ন হয় ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে এসে।
১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর এ বৃহত্তম মসজিদটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন অস্ট্রিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুডফ ক্রিসেলগার। মসজিদের গম্বুজটির উচ্চতা ১৬ মিটার এবং ব্যাস ২০ মিটার। মিনারটির উচ্চতা ৩২ মিটার। এ কেন্দ্রটি মসজিদ ছাড়াও ইসলামি শিক্ষা ও ইসলামিক সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা প্রদান করে থাকে।
এই ইসলামি কেন্দ্র ও মসজিদ ছাড়াও রাজধানী ভিয়েনার বাইরে গ্রাস, সালসবব্রুর্গ, লিনস ও ক্লাগেনফুট শহরেও বেশ কয়েকটি মসজিদ আছে।
মজার বিষয় হলো, সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশি মুসলমানদের পরিচালিত পাঁচটি মসজিদ রয়েছে। যেগুলোতে নিয়মিত নামাজ আদায়ের পাশাপাশি কোরআন মাজিদ শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।