কেয়ামতের কঠিন দিনে যারা নিঃস্ব ও দেউলিয়া হবে

বিশেষ নিবন্ধ, ইসলাম

মাওলানা ফখরুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2025-01-11 18:34:49

ইসলামে ধোঁকা দেওয়া কিংবা প্রতারণা করা নিষিদ্ধ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বাজারে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভেতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভেতরের খাদ্যগুলো ভেজা। এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.) বললেন, হে খাবারের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টি পড়েছিল। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি সেটাকে ওপরে রাখলে না কেন, যাতে লোকেরা দেখতে পেত? যে ধোকা দেয় সে আমার উম্মত নয়। -সহিহ মুসলিম : ১০২

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ধোঁকা বা প্রতারণার ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। বিভিন্নভাবে মানুষ প্রতারণার শিকার হয়। মানুষের আচার-আচরণ, লেনদেন, আদান-প্রদান, কথা-বার্তা, কাজে-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মানুষ প্রতারিত হয়। যারা ধোঁকা ও প্রতারণা করে তাদেরকে প্রতারক বলা হয়। ইসলামে ধোঁকা ও প্রতারণা করা নিষিদ্ধ। বর্তমানে ধোঁকা ও প্রতারণা মহামারির মতো ব্যাপকতা লাভ করেছে।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় প্রতারণা অনেকটা গা সহায় হয়ে পড়েছে, বলা যেতে পারে এই মহা অন্যায়ের কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করেছি অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, প্রতারণা ও ধোঁকার সামনে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। ফলে এটিকে কেউ এখন অপরাধ মনে করে না। একটি নিছক সাধারণ বিষয় হিসাবে সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়েছে। কারণ শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ইসলামের নামদারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং অনৈসলামিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দু’জনের বিবেকই মরে গেছে। খাদ্যে ভেজাল ও বিষাক্ত ফরমালিন মেশানো, ওজনে কম দেওয়া, বিভিন্ন পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দ্বারা ন্যায় বিচারকে প্রভাবিত করা এবং আদালতের রায় নিজের পক্ষে নিয়ে নেওয়া, সরকারি চিকিৎসকদের কর্তব্যে অবহেলা করে নিজের প্রইেভেট ক্লিনিকে রোগীকে নিয়ে যাওয়া, স্কুল শিক্ষক ক্লাশের পড়ার বদলে নিজের কোচিং বাণিজ্য করা, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পালন না করা ইত্যাদি বিষয়গুলো সমাজে সাধারণ বিষয়ে পরিগণিত হয়ে পড়েছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এগুলোকে এখন আর কেউ অপরাধ মনে করে না।

আপনার বিবেক যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে আপনি কাউকে ধোঁকা দিতে পারেন না বা কারো সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবেন না। আপনি নিজেও কারো দ্বারা প্রতারিত হবেন না। যেকোনো মানুষকে প্রতারিত করা এমন কি কোনো অবুঝ প্রাণীকেও প্রতারিত করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। ধোঁকা ও প্রতারণা একটি ঘৃণিত ব্যাধি।

ধোঁকা-প্রতারণা নীতি বিবর্জিত হারাম কাজ। এ জন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয় বা প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ ধোঁকা-প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ হারাম। এ ধরনের সম্পদ দিয়ে উদর পূর্তি করার কারণে তার শরীর হারামে পরিপূষ্ট হয়। এ ধরনের অর্জিত সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় দান-সাদকা করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

সমাজ জীবনে এমন অনেক প্রতারককে দেখা যায়, যারা দান-সদকার ব্যাপারে উদার। মসজিদ-মাদরাসার কমিটিতে তিনি সভাপতি ও সম্পাদক পদে নিয়োজিত। মসজিদ-মাদরাসার নির্মাণ কাজে তার দানের অংশ সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের ব্যক্তিদের দান-সদকা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না।

প্রতারণার শাস্তি অত্যন্ত মারাত্মক। কেয়ামতের দিনে সে নিঃস্ব হত দরিদ্র ও দেউলিয়া হয়ে পড়বে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা কি বলতে পারো, দরিদ্র কে? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে যার দিরহাম (টাকা-কড়ি) ও আসাবাবপত্র (ধন-সম্পদ) নেই সেই তো দরিদ্র। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই প্রকৃত অভাবগ্রস্ত, যে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে। অথচ সে এই আসবে যে, সে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ ভোগ করেছে, একে হত্যা করেছে ও একে মেরেছে। এরপর তার কাছে (পাওনাদারের) প্রাপ্য তার নেক আমল থেকে পূরণ করা গেলে ঋণের বিনিময়ে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -সহিহ মুসলিম : ৬৩৪৩

অন্যায়ভাবে কারো ক্ষতি করা হলে কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা হলে সেটি হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক অপহরণের অপরাধে অপরাধী হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত ভয়ানক বিষয়। এ ধরনের অপরাধের গোনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। তবে সে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়, হয়তো বা আল্লাহ মহান মাফ করতেও পারেন। হাশরের মাঠে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার আগেই আপনাকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। অন্যথায় ওপরের হাদিসে দেখেছেন কিভাবে দেউলিয়া হতে হবে। ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হতে হবে।

মনে রাখতে হবে, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা শয়তানের বৈশিষ্ট্য। সেই প্রথম হজরত আদম (আ.) এবং মা হজরত হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে প্রতারণা করেছিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর সে কসম খেয়ে বললো, আমি তোমাদের যথার্থ কল্যাণকামী। এভাবে প্রতারণা করে সে তাদের দুজনকে ধীরে ধীরে নিজের পথে নিয়ে এলো।’ -সুরা আরাফ : ২১-২২

ধোঁকা যেহেতু একটি মিথ্যা। সেহেতু ধোঁকাবাজ বা প্রতারক একজন খাঁটি মিথ্যাবাদীও বটে। কারণ কাউকে ধোঁকা দিতে হলে অবশ্যই মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। উল্লেখ্য, মিথ্যাবাদী একজন খাঁটি মুনাফিক। কারণ মুনাফিকের চারটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো, যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে। -সহিহ বোখারি : ৩৪

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে একটি গুণও পাওয়া যাবে সেও মুনাফিক। ধোঁকাবাজ শয়তানের প্ররাচনায় মানুষ ধোঁকায় নিপতিত হয়। এমনকি অনেকে এই জঘন্য কাজে স্বাদ খুঁজে পায়। অথচ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ধরনের ব্যক্তিকে মুসলিম উম্মাহ থেকে বহিষ্কার করেছেন। শয়তানি এই বৈশিষ্ট্য থেকে বেরিয়ে আসুন। কখনও কাউকে কোনোভাবেই প্রতারিত করবেন না। সঠিক ও সৎকর্মনীতির ওপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর