রমজান প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাস

রামাদ্বান কারীম, ইসলাম

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 18:14:18

পবিত্র রমজান মাসের বার্তা দিয়ে নতুন চাঁদের নূরানী আলোয় সমগ্র জগৎ উদ্ভাসিত হয়েছে। সর্বত্র উচ্চকিত হচ্ছে স্বাগতম-ধ্বনি- ‘আহলান ওয়া সাহলান’, ‘খোশ আমদেদ মাহে রামাদ্বান।’ ‘রামাদ্বান কারীম’ বলে বিশ্বব্যাপী মুসলমান পবিত্র মাসকে বরণ করে নিয়েছে। যে মাসে রয়েছে রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের সওগাত।

মুসমানদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা ও বরকতময় মাস রমজান। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৮৩-১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল কোরআন। যা মানব জাতির জন্য সঠিক পথপ্রদর্শনকারী। সঠিক পথে চলার জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী, হক/সত্য ও বাতিল/মিথ্যকে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনকারী। তোমাদের মথ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে পুরো মাসটিতে রোজা রাখবে।’

পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী মানুষের মধ্যে ‘তাকওয়া’র গুণ সৃষ্টির লক্ষ্যে রোজা পালনকে ফরজ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘তাকওয়া’র অর্থ হলো- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের অনুভূতি। আল্লাহতায়ালার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস এবং তার সীমাহীন অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগ্রত হয়। আর তার অন্যান্য গুণাবলী, যেমন রাগ-ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস লালনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তার প্রতি ভয়ের ও মান্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা ও ভয়ের এ মিলিত মানসিক অবস্থার নাম ‘তাকওয়া’।

বস্তুতপক্ষে, ‘তাকওয়া’ হলো- সকল ভালো কাজের উৎস; সকল মন্দ কাজ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায়। ‘তাকওয়া’র গুণাবলী অর্জনকারী ‘মুত্তাকি’ নামে অভিহিত, যে নিজে সৎ কর্মশীল থেকে আপামর মানুষকে সৎ কাজের প্রতি আদেশে দিতে পারঙ্গম আর নিজে সর্ব প্রকার অসৎ থেকে বিরত থেকে তাবৎ মানব-প্রজন্মকে অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকবার কাজে নিষেধ প্রদান করতে সক্ষম এবং তিনি মানুষকে আহ্বান জানাবেন কল্যাণের পথে। আর এ কথা তো সকলে জানা যে, প্রকৃত প্রস্তাবে মুসলমানদেরকে সৃজন করাই হয়েছে মানব জাতিকে সকল প্রকার অকল্যাণ থেকে বিরত রেখে কল্যাণের পথ দেখানোর জন্য। এ মহান কাজেই পুরোটা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন রাহমাতুল্লিল আলামীন নবী মুহাম্মদ মুস্তফা আহমাদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জাগতিক ধন-সম্পদ আহরণ বা পদ-পদবী গ্রহণের বদলে তিনি জীবন উৎসর্গ করে গেছেন আল্লাহতায়ালা কর্তৃক একমাত্র মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা ইসলামকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণকামী কাঠামোতে উপস্থাপনের ঐশী দায়িত্ব পালনের কাজে।

রমজান মাসে কৃচ্ছতার মাধ্যমে মানুষ নিজের রিপুকে দমন করতে পারে। খোদাভীতির গুণে সমৃদ্ধ হতে পারে। আল্লাহর পথে চলার প্রেরণাও লাভ করা সম্ভব রমজানের ঐতিহাসিকতার আলোকে। কারণ, ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথম যে রমজান মাস এসেছিল, তার ১৭ তারিখ আরবের কাফেররা হামলা চালায় নতুন ধর্মকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। বদরের ময়দানে হাজার হাজার কাফেরের আগ্রাসী-আক্রমনকারী সুসজ্জিত বাহিনীকে মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে ইসলামের শান্তি ও কল্যাণের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রেখেছিলেন এই ‘তাকওয়া’ বা খোদাপ্রেম ও ভীতির মিলিত শক্তিতে। সেদিন ইসলামের বিজয়ের জন্য কাফেরদের জাগতিক শক্তি কোনও প্রতিরোধ গড়তে পারেনি, ‘তাকওয়া’র শক্তির সামনে পরাজিত ও অবনত হয়েছিল।

ঈমান ও তাকওয়ার শিক্ষা নিয়ে আল কোরআন নাজিল হয়েছে রমজানের এক মহিমান্বিত রজনীতে, যে রজনীর নাম শবেকদর, হাজার মাসের চেয়েও উত্তম যে রাত। রমজানে সুযোগ রয়েছে ইতেকাফের।

পবিত্র কোরআন অবর্তীণ হওয়ার মাস রমজান আমাদের সামনে অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে। এ মাসে পবিত্র কোরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে আর ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন-কর্ম-কথায় অনুসৃত আদর্শ বা সুন্নত পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা তাকওয়ার গুণে আত্ম-উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাতে পারে। নিজেদেরকে উজ্জ্বল আদর্শস্বরূপ উপস্থাপন করতে পারে উত্তম জীবনের পথে, মানবতার কল্যাণে। নিপীড়ণ-আগ্রাসনমুক্ত শান্তি বিশ্ব গড়ার শপথ নিতে পারে।

কারণ মাহে রমজান হলো- প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাস। রোজাব্রত পালনের কৃচ্ছতা সাধনের মাধ্যমে আমরা যেমন নিজের চিন্তা-চাহিদা ও চেতনার সকল অশুভ তাগিদকে পরাজিত করতে পারি, তেমনি পারি বিশ্বের সকল অকল্যাণকে মিটিয়ে দিতে; আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, সাম্রাজ্যবাদের মত মানবতা-বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।

পবিত্র মাহে রমজানে প্রতিটি দিনে রোজা এবং রাতে নামাজ ও তেলাওয়াতের প্রশিক্ষণ ও প্রচেষ্টার পথে তাকওয়ার রঙে জীবনকে রাঙানোর যে অমূল্য সুযোগ এসেছে, তা কাজে লাগাতে পারলেই মুসলমানের ব্যক্তি জীবন সফল হবে। একটি কথা কোনোভাবেই ভুলে গেলে হবে না যে, পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালার স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে কল্যাণের জন্য। কারণ তোমরা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে। সৎ কাজের আদেশ করবে আর অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।’

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দিকে, কল্যাণের দিকে ডাকে উত্তম ভাষা ও সদুপদেশের মাধ্যমে।’

অতএব, মুসলমান যদি তার উপর অর্পিত বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন-কল্যাণকামীতার দায়িত্ব বিস্মৃত হয়, তাহলে পুরো বিশ্বের মতো তারাও অকল্যাণে নিপতিত হবে। আর যদি কল্যাণকামীতার প্রচার ও প্রসারে কুরআন ও সুন্নাহর প্রদর্শিত পথে চলে, তাহলে নিজেদের কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে সারা দুনিয়ার কল্যাণও নিশ্চিত করতে পারবে।

পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সার্বজনীন-কল্যাণের শ্বাশত চেতনায় সকল অকল্যাণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজয়ী করার পথে আমাদের এগিয়ে দিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর