রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির সওগাত নিয়ে মুসলিম মিল্লাতের নিকট আগমন করেছিল সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। এ পবিত্র মাস সহমর্মিতা, সংযম, ধৈর্য ও প্রতিরোধের সুমহান বার্তা নিয়ে আগমন করেছিল। একে একে পরিপূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে মাহে রমজানের রূপালি চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণ। পূণ্যাশ্রয়ী জীবন গঠন ও সত্যনিষ্ঠতার বাস্তব অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে মাহে রমজানের দিনগুলো।
সিয়াম সাধনা মুসলিম মিল্লাতকে পাপাচার, কামাচার ও মিথ্যাচার থেকে বিরত রাখার যে প্রশিক্ষণ দেয়, তা পরবর্তী জীবনের সবক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হওয়াই এর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার প্রশিক্ষণ চলে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে।
মাহে রমজানের এই বিদায়ক্ষণে চিন্তা করা উচিত- এ পবিত্র মাহে রমজান আমাদেরকে যে শিক্ষা দিয়ে গেল, তা আমরা বাস্তব জীবনের বাকি এগারো মাসে কীভাবে প্রয়োগ করতে পারি। রোজাদারদের মধ্যে কেউ হয়তো পূর্বে অবৈধ পথে অর্থোপার্জন করত, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণা করত, মদ্যপান, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল, অন্যায়ভাবে অন্যের হক নষ্ট করত, গিবত চর্চা ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস, নিজের শালীনতা ও পবিত্রতা বজায় না রেখে বেগানা নারী-পুরুষের সঙ্গে অবাঞ্চিত কথা-কাজের সম্পর্ক ছিল, দায়িত্বে অবহেলা করত, আমানতের খিয়ানত করত, অপরাধ প্রবণতা দূর না করে তা লালন করত- যদি এ মাসের প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে বাকি জীবনে এ সব অবাঞ্চিত কাজ পরিহার করার শপথ না নিতে পারি তাহলে রমজান মাসের আগমন এবং রোজা রাখা আর না রাখা আমাদের জন্য সমান হয়ে দাঁড়ালো।
হজরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল আর মিথ্যা কথা ও খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না, তার না খেয়ে থাকার প্রয়োজন আল্লাহতায়ালার কাছে নাই। (অর্থাৎ তার রোজা আল্লাহতায়ালা কবুল করবেন না)। -সহিহ বোখারি
আমাদের সমাজ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতার কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এ সব অপরাধ প্রবণতা নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সকল ধরনের মূল্যবোধকে গ্রাস করে চলেছে। কিন্তু আমরা মাহে রমজানের রোজার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এ সব সমস্যার মধ্যে আরও অধিক জড়িয়ে পড়ছি। আমাদের সমাজে যত লোক রোজা রাখে সে তুলনায় বাস্তবজীবনে তার প্রতিফলন খুবই কম। তাই দিন দিন আমাদের সমাজ জীবন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার সুমহান বার্তা নিয়ে বছর পরিক্রমায় আমাদের মাঝে হাজির হয় মাহে রমজান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মাহে রমজান আমাদের জীবনে অনেকবার এসেছে অথচ আমাদের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা সিয়ামের যথার্থতা উপলব্ধি করতে পারিনি। আমরা রোজাও রাখি, তারাবিও পড়ি কিন্তু রোজার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার প্রয়োজন ছিল, সেই পরিবর্তন এখনো আমাদের মাঝে আসেনি। বছরের বাকি এগারো মাস তথা জীবনের বাকি অংশকে সুন্দর, পরিশুদ্ধ ও সংযমের অধিকারী করার জন্যই মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা। এসব বিষয় আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং রমজানের সুমহান শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের অন্যায়, অসত্য, জুলুমবাজি ইত্যাদির সমূলে শক্ত আঘাত হানতে হবে।
মাহে রমজানের রোজা আমাদেরকে সাম্য, মৈত্রী, একতা, ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি, শৃঙ্খলা, একনিষ্ঠতা, নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি মানবীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দিয়ে থাকে। ধনী-দরিদ্র, আমির-ফকির যে একই ভ্রাতৃত্বের অন্তর্গত এবং একের প্রতি অন্যের যে দায়িত্ব কতো বড় আমরা তা এই রমজান মাসেই অনুভব করতে পারি। রোজার ক্ষুধার মাধ্যমে দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের নিত্যদিনের ক্ষুধার কষ্ট আমরা এই রমজান মাসেই বেশি উপলব্ধি করতে পারি। এই উপলব্ধি হতে দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
রমজান মাসে কোরআনে কারিম অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাস। এ মাসেই নাজিল হয়েছে আল কোরআন। এটা মানবজাতির জন্য জীবনযাপনের বিধান এবং এমন সুস্পষ্ট উপদেশ, যা সঠিক ও সত্যপথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরে।' -সূরা আল বাকারা: ১৮৫
তাই মাহে রমজানের মূল শিক্ষা হওয়া উচিত আমরা আমাদের বাকি জীবনে মহাগ্রন্থ আল কোরআন পঠন-পাঠন, তার মর্ম বুঝা, সে অনুযায়ী নিজের জীবন গঠনের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের কাছাকাছি অবস্থান করা। এজন্য পবিতত্র কোরআন আমাদেরকে বেশি বেশি তেলাওয়াত করতে হবে, অর্থ বুঝতে হবে, তাফসির পড়তে হবে, হাদিস গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে হবে এবং আল্লাহতায়ালার প্রত্যেকটি বাণীর মর্ম বুঝার চেষ্টা করতে হবে। তবেই আমাদের নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কারণ পবিত্র কোরআন গোটা মানবসমাজকে ন্যায়-নীতির পথে চলার জন্য সমস্ত উপদেশ ও আদেশ-নিষেধে ভরপুর।
প্রকৃতপক্ষে পবিত্র মাহে রমজান মুসলমানদের ব্যক্তি জীবন থেকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সর্বস্তরে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পালনের দীক্ষা দিয়ে যায়। সুতরাং মাহে রমজানের শিক্ষা আমাদের জীবনের সকল পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক।