ঈদুল ফিতরের আমলসমূহ

ঈদ, ইসলাম

মাওলানা আবদুল জাব্বার, অতিথি লেখক, ইসলাম, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 18:26:41

ঈদ শব্দটি আরবি। এর অর্থ বারবার ফিরে আসা, ঘুরে ফিরে আসা, জমায়েত হওয়া, খুশি, আনন্দ, অভ্যাস ইত্যাদি। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি প্রতি বছর বারবার ফিরে আসে। এটা আরবি শব্দ ‘আদা ইয়াউদু’থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আবার অনেকে বলেন, এটা আরবি শব্দ ‘আদত’ বা অভ্যাস থেকে উৎপন্ন। কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। সে যাই হোক, যেহেতু এ দিনটি বারবার ফিরে আসে ও মুসলমানরা এ দিনে তাদের প্রভুর নির্দেশ পালন করে আনন্দ পান তাই এর নামকরণ করা হয়েছে ঈদ।

ঈদের একাধিক অর্থ থাকলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ঈদ বলতে খুশিই বুঝে থাকেন। এ খুশির ঈদ আমাদের মাঝে আসে প্রতি বছর দুইবার। একটিকে আমরা বলি ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ, আর অন্যটিকে বলে থাকি ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। ঈদুল ফিতর মাহে রমজানে পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন ও ক্ষুধাতুরের কষ্ট অনুভব করার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ইসলামে ঈদের প্রচলন
আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে যেসব নিয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে ঈদ অন্যতম। হাদিসে এসেছে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনাবাসীর দু’টো দিবস ছিলো, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এ দুই দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসী উত্তর দিলেন, আমরা মূর্খতার যুগে এ দুই দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দুই দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হলো- ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ –সুনানে আবু দাউদ: ১১৩৪

ঈদের দিনে করণীয়
ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা
ঈদের দিন ভোরে ফজর নামাজ জামাতে আদায় করার মাধ্যমে দিনটি শুরু করতে হবে। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি তারা এশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারত তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দু’টি নামাজের জামাতে শামিল হতো। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও সুগন্ধি ব্যবহার করা
ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সব মানুষ নামাজ আদায়ের জন্য মিলিত হন। হজরত ইবনে উমার (রা.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। হজরত ইবনে উমার (রা.) থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত, তিনি দুই ঈদের দিনে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। -বায়হাকি

ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, আমি আলেমদের কাছ থেকে শুনেছি তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও সাজ-সজ্জাকে মোস্তাহাব বলেছেন। -আল মুগনি: ইবনে কুদামাহ

ইবনুল কাইয়্যুম (রহ.) বলেছেন, নবী করিম (সা.) দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। -যাদুল মায়াদ

এ দিনে সব মানুষ একত্রে জমায়েত হন, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হলো- তার প্রতি আল্লাহর যে নিয়ামত তা প্রকাশ করণার্থে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা।

হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া
ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য তাড়াতাড়ি ঈদগাহে যাওয়া। হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত। হাদিসে এসেছে, হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুন্নত হলো- ইদগাহে হেঁটে যাওয়া। ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদিসটি হাসান। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ অনুযায়ী আমল করেন এবং তাদের মত হলো পুরুষ ঈদগাহে হেঁটে যাবেন, এটা মোস্তাহাব। আর গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহন করবেন না।

এক পথে গিয়ে অন্য পথে আসা
ঈদগাহে এক পথে গিয়ে অন্য পথে ফিরে আসা সুন্নত। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন। -সহিহ বোখারি

অর্থাৎ যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে পথে ফিরে না এসে অন্য পথে আসতেন। এটা এ জন্য, যাতে উভয় পথের লোকদের সালাম দেওয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। -যাদুল মায়াদ

তাকবির দেওয়া
হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন। ঈদের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন। যখন নামাজ শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবির পাঠ করতেন না। সাহাবি হজরত ইবনে উমার (রা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করতেন। ঈদগাহে এসে ইমামের আগমন পর্যন্ত এভাবে তাকবির পাঠ করতেন। শেষ রমজানের সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতে হবে। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশে যখন বের হবেন ও ঈদগাহে নামাজের অপেক্ষায় যখন থাকবেন তখন গুরুত্বসহকারে তাকবির পাঠ করবেন।

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা
ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন- ক. হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, ‘জোবায়ের ইবনে নফির থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসূলে কারিম (সা.)-এর সাহাবারা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়ামিনকুম’ অর্থ আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। -ফতহুল বারি

খ. ঈদ মোবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লিখিত বাক্য দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবারা এ বাক্য ব্যবহার করতেন ও এতে পরস্পরের জন্য কল্যাণ কামনা ও আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া রয়েছে।

ঈদের নামাজের আগে খাবার গ্রহণ
ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজ আদায়ের আগে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত।

হজরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাজের আগে খেতেন না। নামাজ থেকে ফিরে এসে কোরবানির গোশত খেতেন। -আহমদ

ঈদের নামাজ আদায় ও খুতবা শোনা
জামাতের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে। ঈদের নামাজ ওয়াজিব। ঈদের নামাজের পর ইমাম দু’টো খুতবা দেবেন। খুতবা শোনা ওয়াজিব।

ফিতরা আদায় করা
ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা আদায় করে দেওয়া একটি বড় ধরনের ইবাদত। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, গোলাম-আজাদ সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে হবে। শিশু ও গোলামের পক্ষ থেকে তার মনিব বা অভিভাবক ফিতরা আদায় করবে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন অশ্লীল ও অনর্থক কথার দ্বারা রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতিকে পবিত্র করা এবং মিসকিনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের নামাজের আগে আদায় করলে তা ফিতরা হিসেবে ধর্তব্য আর ঈদের নামাজের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মতো একটি দান হবে।

ঈদ হোক সবার জন্য আনন্দের, খুশির; হোক ইবাদতের দিন। ঈদ বয়ে আনুক শান্তি-শৃঙ্খলা ও শালীন বিনোদন। ঈদকে ইবদত হিসাবে পালন করতে চাইলে অবশ্যই উল্লিখিত বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর