কোরবানি সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর ওয়াজিব বা অবশ্যই করণীয় একটি আমল। এটি পশু জবাইয়ের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশের বিশেষ উপলক্ষ। কোরবানির আসল বিষয় হচ্ছে ত্যাগ ও আত্মবিসর্জন। নিজেকে স্রষ্টার সামনে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ। নিজের ছেলেকে জবাই করার মতো কঠিন নির্দেশ দেয়া হয়েছিল হজরত ইবরাহিম (আ.) কে। সেই মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহিম (আ.) খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। প্রিয় সন্তানকে জবাই করার মতো কঠোর নির্দেশনা নয়, পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। তবে সেটা নির্ভর করে নিয়ত ও ইখলাসের ওপর।
স্বচ্ছ হৃদয়ে, খাটি নিয়তে কোরবানি করলেই আল্লাহর দরবারে তা কবুল হবে। অন্যথায় এই 'রক্তপাতে' কোনো লাভ নেই। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কোরবানির পশুর মাংস, রক্ত কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না; পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া। আর এই তাকওয়ার উপস্থিতি না থাকলে পশু কোরবানির কোনো সার্থকতা নেই। এজন্য নিষ্পাপ পশুর গলায় ছুরি চালানোর আগে নিজের মনের পশুটাকে কোরবানি দিতে হবে।
আজকাল আমাদের সমাজে তাকওয়ার পরিবর্তে মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পশুটা এই কোরবানি উপলক্ষে আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে। কে কত বেশি দামের কোরবানি দিচ্ছেন এর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তে কেউ এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করলে সেটা নিশ্চয় ভালো জিনিস। তবে লৌকিকতায় কলুষিত প্রতিযোগিতার কোনো মূল্যায়ন আল্লাহর কাছে নেই। প্রত্যেকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কোরবানি বা বিসর্জন দেবে এটাই আল্লাহ চান। কে কত দামি পশু কোরবানি করেছে সেটার দিকে আল্লাহর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি শুধু দেখেন মানুষের অন্তর।
কোরবানির জরুরি কিছু বিধান
ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট এই ছয় ধরনের পশু দ্বারা কোরবানি দেয়া যায়। এর বাইরে অন্য কোনো পশু দ্বারা কোরবানি বৈধ নয়। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কমপক্ষে এক বছর বয়সের হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে। উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। কোরবানির পশু ভালো এবং হৃষ্টপুষ্ট হওয়াই উত্তম। কোরবানির পশুতে কোনো খুঁত থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
ছাগল, ভেড়া, দুম্বায় একজনের বেশি শরিক হয়ে কোরবানি করা যায় না। গরু, মহিষ, উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারেন। তবে কারও অংশ সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম হলে তা হবে না। মৃত ব্যক্তির নামেও কোরবানি হতে পারে। যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব তার নামেই কোরবানি দিতে হবে। নিজের নামে দেয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের নাম যোগ করা যাবে। তবে নিজের নাম না দিয়ে অন্যের নামে কোরবানি করা ঠিক হবে না।
নিজের কোরবানির পশু নিজে জবাই করা সবচেয়ে উত্তম। রাসুল (সা.) নিজের পশু নিজে জবাই করতেন। তবে অন্য কাউকে দিয়ে জবাই করানোরও সুযোগ আছে। একটি পশুতে কতজন শরিক সেটা জবাইয়ের আগেই নির্ধারণ করে নিতে হবে। কাগজে লিখিত আকারে উল্লেখ করার দরকার নেই, মনে মনে নিয়ত থাকলেই যথেষ্ট। জবাইয়ের সময় পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে এবং পা পশ্চিম দিকে রেখে অর্থাৎ কেবলামুখি করে শোয়ায়ে পূর্ব দিক থেকে চেপে ধরতে হবে, তারপর ছুরি চালাতে হবে। জবাইয়ের ছুরি যেন খুব ধারালো হয়, পশুর যেন কষ্ট কম হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা উত্তম। এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ গরিবদের জন্য, আর এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের জন্য। তবে এ ধরনের বণ্টন করা ওয়াজিব নয়, মুস্তাহাব। বরং পুরো নিজে রেখে দিলেও কোনো অসুবিধা নেই, তবে তা অনুত্তম। কোরবানির গোশত শুকিয়ে বা ফ্রিজে রেখে দীর্ঘদিন খাওয়াতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে সমাজের সামর্থ্যহীন, গরিব-দুঃস্থদের বঞ্চিত করে নিজের ফ্রিজ ভরে রাখাটা সমীচীন নয়।
কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবহারের উপযুক্ত করে কোরবানিদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে বিক্রি করলে পুরো মূল্য সদকা করা জরুরি। সদকার ক্ষেত্রে গরিব আত্মীয়-স্বজনকে প্রাধান্য দেয়া উত্তম। আর যে সব দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরিব ও এতিম ছাত্রদের ভরণ-পোষণ ও তাদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, সেখানে চামড়ার মূল্য দান করলে অধিক সাওয়াবের আশা করা যায়। কোরবানির পশু জবাইকারী ও কসাইয়ের পারিশ্রমিক আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হবে। কোনোক্রমেই তা কোরবানি চামড়া বা গোশত দিয়ে পরিশোধ করা জায়েজ নেই।
কোরবানি করা হয় আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এটি একটি মহান ইবাদতও বটে। ত্যাগের এই ইবাদতটুকু লৌকিকতায় যেন বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে সে দিকে সবার লক্ষ্য রাখা উচিত। একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যাবতীয় বিধিবিধান পুরোপুরি জেনে কোরবানি করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জরুরি।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম