কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারপর সে নামাজিদের জন্য ধ্বংস। যারা নিজেদের নামাজের ব্যাপারে গাফিলতি করে।’ -সূরা মাউন: ৪-৫
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আয়াতের শুরুতে ‘ফা’ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ফা’ অক্ষর ব্যবহারের তাৎপর্য হলো- প্রকাশ্যে যারা আখেরাত অস্বীকার করে তাদের অবস্থা তুমি এখনই শুনলে আর এখন যারা নামাজ পড়ে অর্থাৎ মুসলমানদের সঙ্গে শামিল মুনাফিকদের অবস্থাটা একবার দেখো। তারা বাহ্যত মুসলমান হওয়া সত্বেও আখেরাতকে মিথ্যা মনে করে, তাই দেখো তারা নিজেদের জন্য কেমন ধ্বংসের সরঞ্জাম তৈরি করছে।
এখন প্রশ্ন হলো- ধ্বংসের কাতারে থাকা ওই মুসল্লি কারা? ইসলামি স্কলাররা কোরআর-হাদিসে আলোকে বলেছেন, ওই মুসল্লিরা (নামাজি) হলো-
ক. যাদের কাছে নামাজ পড়া ও না পড়া উভয়টিরই গুরুত্ব এক ও অভিন্ন।
খ. কখনও তারা নামাজ পড়ে আবার কখনও পড়ে না।
গ. যখন নামাজ পড়ে, নামাজের আসল সময় থেকে পিছিয়ে যায় এবং সময় যখন একেবারে শেষ হয়ে আসে, তখন উঠে গিয়ে চারটি ঠোকর দিয়ে আসে।
ঘ. নামাজের জন্য ওঠে ঠিকই কিন্তু একবারে যেন উঠতে মন চায় না এমনভাবে ওঠে এবং নামাজ পড়ে নেয় কিন্তু মনের দিক থেকে কোনো সাড়া পায় না। যেন কোনো আপদ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঙ. নামাজের চেয়ে কাজের গুরুত্ব বেশি দেওয়া। নামাজের সময় চলে যাচ্ছে তিনি কাজে নিমজ্জিত আছেন।
চ. নামাজে দাঁড়িয়ে কাপড় নিয়ে খেলা করে, হাই তুলে, আল্লাহর স্মরণ সামান্যতম তাদের মধ্যে থাকে না। পুরো নামাজের মধ্যে তাদের এ অনুভূতি থাকে না যে, তারা নামাজ পড়ছে।
ছ. নামাজের মধ্যে পঠিত কোরআনের আয়াত, তাসবিহ ও দোয়াগুলো তোতাপাখির মতো আওড়ে যায়। কখন কী পড়ছে সেদিকে তাদের কোনো খেয়াল থাকে না। ফলে নামাজ পড়তে থাকে কিন্তু মন চলে যায় দূরে, বহু দূরে।
জ. তাড়াহুড়া করে এমনভাবে নামাজ পড়ে, যাতে রুকু ও সিজদা কোনোটাই ঠিকমতো হয় না। কেননা, কোনো প্রকারে নামাজ পড়ে দ্রুত দায়িত্ব শেষ করা।
ঝ. কোনো জায়গায় আটকা পড়েছে, চলো এ ফাঁকে নামাজ সেরে নেই। কিন্তু তাদের জীবনে ইবাদতের আলাদা কোনো গুরুত্ব কিংবা মর্যাদা নেই।
ঞ. নামাজের সময় এসে গেলে এটা যে নামাজের সময় এ অনুভূতি অনেকের মধ্যে থাকে না। মোয়াজ্জিনের আজানের আওয়াজ কানে এলেও এটা কিসের আহ্বান জানাচ্ছেন, কাকে এবং কেন জানাচ্ছেন এ কথাটা একবারও চিন্তা করে না।
উল্লেখিত আলামতগুলোই আখেরাতের প্রতি ঈমান না রাখার আলামত। কারণ মুসলমান হিসেবে দাবিদাররা নামাজ পড়লে কোনো পুরস্কার পাবে বলে মনে করে না এবং না পড়লে তাদের কপালে শাস্তি ভোগ আছে এ কথা বিশ্বাস করে না। এ কারণে তারা এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে।
এ জন্য হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর শোকর (কৃতজ্ঞতা) তিনি ‘ফি সালাতিহিম’ বলেননি, বরং বলেছেন ‘আন সালাতিহিম সাহুন’ অর্থাৎ আমরা নামাজে ভুল করি ঠিকই কিন্তু নামাজ থেকে গাফেল হই না। এ জন্য আমরা মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত হবো না।
কোরআনে কারিমে মুনাফিকদের এ অবস্থাটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘তারা যখনই নামাজে আসে অবসাদগ্রস্তের মতো আসে এবং যখনই আল্লাহর পথে খরচ করে অনিচ্ছাকৃতভাবে করে।’ -সূরা তাওবা: ৪
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এটা মুনাফিকের নামাজ, এটা মুনাফিকের নামাজ, এটা মুনাফিকের নামাজ। সে আসরের সময় বসে সূর্য দেখতে থাকে। এমনকি সেটা শয়তানের দু’টো শিংয়ের মাঝখানে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময় নিকটবর্তী হয়, তখন সে উঠে চারটে ঠোকর মেরে নেয়। তাতে আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করা হয়।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
নবী করিম (সা.)-এর জামানায় কোনো ব্যক্তি নিয়মিত নামাজ না পড়ে মুসলমানদের দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারত না। আর যদি সে অনবরত কয়েক ওয়াক্ত নামাজ জামাতে অনুপস্থিত থাকত, তাহলে ধরে নেওয়া হতো সে মুসলমান নয়। তাই বড় কট্টর মুনাফিকরাও সে যুগে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে হাজিরা দিত। কারণ এ ছাড়া মুসলমানদের দলে অন্তর্ভুক্ত থাকার আর দ্বিতীয় কোনো পথ ছিল না। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল এ রকম যে, আজানের আওয়াজ তার কানে আসতেই মুনাফিকদের যেন জান বেরিয়ে যেত। মন চাইত না, তবু নেহাত দায়ে ঠেকে তারা উঠত। তাদের মসজিদে আসার ধরন দেখে পরিষ্কার বোঝা যেত যে আন্তরিকভাবে তারা আসছে না, বরং অনিচ্ছায় নিজেদের টেনে টেনে আনছে।
জামাত শেষ হওয়ার পর এমনভাবে মসজিদ থেকে পালাত, যেন মনে হতো কয়েদিরা বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের ওঠাবসা, চলাফেরা তথা প্রতিটি পদক্ষেপ সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিত যে, আল্লাহর স্মরণের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র টান ও আগ্রহ নেই।
সুতরাং নামাজে আমাদের অবস্থাও যদি তাদের মতো হয়, তাহলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।