হাজার মাসের চেয়ে উত্তম যে রাত

, ইসলাম

মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ, অতিথি লেখক, ইসলাম | 2023-08-31 23:58:42

ফার্সি ‘শবেকদর’, আরবি ‘লাইলাতুল কদর’ অর্থ মহিমান্বিত রাত। এ রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। পবিত্র কোরআনে ‘কদর’ নামে স্বতন্ত্র একটি সূরা রয়েছে। ৫ আয়াত বিশিষ্ট এ সূরায় লাইলাতুল কদরের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে ইসলামি শরীয়তে এ রাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে।

আরবি মাসগুলোর মধ্যে রমজান যেমন শ্রেষ্ঠ মাস, তেমনি রমজানের একটি রাত লাইলাতুল কদর। কোরআন-হাদিসের প্রচুর বর্ণনা দ্বারা পবিত্র এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে জানা যায়।

হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল কদরে নামাজ পড়বে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ –সহিহ বোখারি: ১৯০১

হাদিসে ‘ঈমান সহকারে’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, এই রাতের মর্যাদা ও বিশেষ আমল শরিয়তসম্মত হওয়ার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আর ‘প্রতিদানের আশায়’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, নিয়তকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করা।

সূরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আমি এটা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি একটি বরকতময় রাতে।’ আর এ রাত হলো শবেকদর। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ফেরেশতারা এ রাতে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি নিয়ে অবতরণ করেন।’ কারও কারও মতে, ‘আল্লাহতায়ালা এ বছর যেসব বিষয় নির্ধারণ ও ফয়সালা করেছেন, ফেরেশতারা তা নিয়ে অবতরণ করেন।’

লাইলাতুল কদর অতি মূল্যবান রাত হওয়ায় আল্লাহতায়ালা এর সুনির্দিষ্ট তারিখ গোপন রেখেছেন। মুমিনরা যেন এ রাতকে কষ্ট করে অন্বেষণ করে, যাতে তারা কেবল ওই নির্দিষ্ট তারিখ ইবাদত করে অন্য রাতে অলসভাবে না কাটায়; তাই রমজানের বেজোড় রাতগুলোকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে।

সাহাবায়ে কেরাম হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করে পুরো রমজান বিশেষত শেষ দশকের বেজোড় রাতে বেশি বেশি ইবাদত ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন।

কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তা নিয়ে আলেমদের মাঝে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ফাতহুল বারি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ সংক্রান্ত অভিমত ৪০টির ওপরে পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সঠিক মত হলো- লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাত।

হজরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ –সহিহ বোখারি: ২০১৭

রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলিল প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

বিভিন্ন হাদিস থেকে এ বিষয়ে ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। তবে একজন মুসলিমের নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। কারণ এতে করে এমন বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়, আসলে যে বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভবপর নয় এবং এতে করে ব্যক্তি প্রভূত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। হতে পারে লাইলাতুল কদর ২১তম রাতে অথবা ২৩তম রাতে অথবা ২৯তম রাতে। তাই কেউ যদি শুধু ২৭তম রাতে নামাজ আদায় করে তবে তিনি অফুরন্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং এই মোবারকময় রাতের ফজিলত হারাবেন।

ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি কোরআনের সূরা কদরের গবেষণা করে করে ২৭ তারিখ লাইলাতুল কদর হওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তার গবেষণা সূত্র হচ্ছে, কোরআনে লাইলাতুল কদর শব্দটি তিনবার বলা হয়েছে। এ শব্দটিতে ৯টি অক্ষর আছে। সুতরাং ৩ গুন ৯ = ২৭ রমজানে লাইলাতুল কদর হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে।

তাই বলে সাতাশের রাতকেই সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলা উচিত নয়। খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, এ রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভবনা রয়েছে।

এ রাতে মহাগ্রন্থ কোরআন নাজিল হয়, মানবজাতির এই বিরাট নিয়ামতের কারণেই এ রাতের এত মর্যাদা ও ফজিলত। এই কোরআনকে ধারণ করলেই মানুষ সম্মানিত হবে, একটি দেশ ও জাতি মর্যাদাবান হবে; গোটা জাতির ভাগ্য বদলে যাবে। কাজেই এ রাতে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতে হবে। কোরআনের শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে হবে। বাছাইকৃত কিছু আয়াত এ রাতে মুখস্থ করা যেতে পারে। কোরআনের এমন গভীর অধ্যয়ন আমাদের সৌভাগ্যের দ্বার খুলে দেবে।

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদের লাইলাতুল কদর সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য বের হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তির ঝগড়ার কারণে আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ –সহিহ বোখারি

সুতরাং দুই ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দেওয়াও এ রাতের অন্যতম ইবাদত।

তা ছাড়া হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি শবেকদর পেয়ে যাই, তবে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করবো? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এ দোয়া পড়বে- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।’ অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে তুমি ভালোবাসো। তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

শেষ নবীর উম্মত হিসেবে আমরা এই মহিমান্বিত রাত পেয়েছি। আর কোনো উম্মতের ভাগ্যে তা জোটেনি। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহর মর্যাদা বৃদ্ধি এবং তার নৈকট্য অর্জনের সুযোগ হিসেবে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এ রাত দান করেছেন, যাতে তারা স্বল্প জীবনে এ রাতে ইবাদত করে মহাসাফল্য লাভ করতে পারে। তাই আমাদের দরকার এ সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা।

রমজান ও শবেকদরে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের কাজে সর্বোচ্চ সাধনা চালানো। এটিই নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক শুরু হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তার পরিবারবর্গকে ইবাদত-বন্দেগির জন্য জাগিয়ে দিতেন।’ –সহিহ বোখারি: ২০২৪

এ সম্পর্কিত আরও খবর