শীতের সময় শীত নিবারণের জন্য মানুষ হাতে ও পায়ে মোজা পরে থাকে। এমতাবস্থায় ইসলামি শরিয়ত মানুষকে শীত থেকে বাঁচার জন্য কিছু স্বতন্ত্র ও সহজ কিছু বিধান দিয়েছে। আর তা হলো, অজুর ক্ষেত্রে পা না ধুয়ে মোজার ওপর মাসেহ করা।
কষ্ট লাঘবের লক্ষে অজু সহজভাবে করার জন্য পা ধোয়ার বিকল্প হিসেবে মোজার ওপর মাসেহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অজু করে চামড়ার মোজা পরতে হবে।
‘মুসাফির’ (শরিয়তে মুসাফির বলা হয়, যে ৪৮ মাইল [প্রায় ৭৮ কিলোমিটার] বা তার বেশি দূরত্বে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজ এলাকা ত্যাগ করে, ভ্রমণরত) ব্যক্তি তিন দিন তিন রাত (৭২ ঘণ্টা) পর্যন্ত মাসেহ করে যেতে পারবেন এবং ‘মুকিম’ (নিজ ঘরে অবস্থানরত) ব্যক্তি এক দিন এক রাত (২৪ ঘণ্টা) মাসেহ করতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মোজার ওপর মাসেহ করার সময় মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত এবং মুকিমের জন্য এক দিন এক রাত।’ -আবু দাউদ
মাসেহ বৈধ হওয়ার শর্তসমূহ
যতক্ষণ পর্যন্ত নিম্নোল্লেখিত শর্তগুলো পাওয়া যাবে, মোজার ওপর মাসেহ বৈধ হবে। শর্তগুলো হলো-
এক. পবিত্র হয়ে মোজা পরা। অর্থাৎ অজু করে পা ধোয়ার পর মোজা পরা। -সহিহ বোখারি: ১৯৯
দুই. মোজা দ্বারা টাখনু ঢেকে থাকা। -সহিহ মুসলিম: ৩৫৪
তিন. মোজা ছেঁড়াফাটা হলে পায়ের ছোট আঙুলের তিন আঙুল পরিমাণের কম ছেঁড়াফাটা থাকতে হবে। -সুনানে আবু দাউদ: ২৪২০
চার. উভয় মোজা বাঁধা ছাড়া পায়ে লেগে থাকা।
পাঁচ. তা ধারাবাহিক চলার উপযোগী হওয়া।
সুতরাং আমাদের দেশে প্রচলিত সুতার মোজার ওপর মাসেহ বৈধ নয়।
মোজর ওপর মাসেহের ফরজ ও সুন্নতসমূহ
মাসেহের ফরজ সীমারেখা: হাতের ছোট তিন আঙুলের সমান পায়ের ওপরের অংশ মাসেহ করা। -সুনানে আবু দাউদ: ১৪০
মাসেহের সুন্নত: পায়ের আঙুলের মাথা থেকে হাতের আঙুলগুলো প্রশস্ত করে টাখনু পর্যন্ত মাসেহ করা। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/১৮৫
মোজা মাসেহের নির্ধারিত মেয়াদ
মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত এবং মুকিমের জন্য এক দিন এক রাত। -সুনানে আবু দাউদ: ১৩৫
মুকিম যদি মাসেহ করার পর সফর আরম্ভ করে, তবে মুসাফিরের সময়সীমা পরিপূর্ণ করবে, তদ্রূপ মুসাফির যদি মাসেহ করার পর মুকিম হয়ে যায়, তবে মুকিমের নির্ধারিত মেয়াদ পূরণ করবে। -আবু দাউদ: ১৩৫
যেসব কারণে মাসেহ ভেঙে যায়
এক. যেসব কারণে অজু ভেঙে যায়, সেসব কারণে মাসেহও ভেঙে যায়। -তিরমিজি: ৬৯
দুই. মোজা খোলার কারণে মাসেহ ভেঙে যায়। -সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি: ১৪২২
তিন. মোজা যদি পায়ের টাখনুসহ বেশিরভাগ অংশ বের হয়ে যায়, তখনও মাসেহ ভেঙে যাবে। -সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি: ১৪২২
চার. নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার মাধ্যমে মাসেহ ভেঙে যায়।-বাদায়ে: ১/৪৬
পাঁচ. উভয় মোজার কোনো একটিতে বেশিরভাগ অংশে পানি পৌঁছে গেলে মাসেহ ভেঙে যায়। -সুনানুল কুবরা: ১৩৯৬
মোজার ওপর মাসেহ সংক্রান্ত আরও কিছু মাসয়ালা
এক. কাপড়ের মোজার ওপর চামড়ার মোজা পরিধান করলেও মাসেহ করা জায়েজ। অবশ্য চামড়ার মোজা পায়ের সঙ্গে এঁটে থাকতে হবে এবং এতে অন্যান্য শর্ত থাকতে হবে।
দুই. চামড়ার মোজার ওপর পরিহিত কাপড়ের মোজায় মাসেহ করা জায়েজ নয়। বরং কাপড়ের মোজা খুলে সরাসরি চামড়ার মোজার ওপর মাসেহ করতে হবে।
তিন. মুসাফির তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত মাসেহ করতে পারবেন। আর তিন দিনের হিসাব শুরু হবে মোজা পরিধানের পর সর্বপ্রথম অজু ভেঙে যাওয়ার সময় থেকে। এটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ওয়াক্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
চার. অজু থাকা অবস্থায় যদি মাসেহের সময়সীমা শেষ হয়ে যায় তাহলে মোজা খুলে উভয় পা ধুয়ে নিলেই চলবে। পুনরায় অজু করা আবশ্যক নয়। তবে নতুন করে অজু করে নেওয়া উত্তম।
পাঁচ. কোনো ব্যক্তি যদি সুস্থাবস্থায় পূর্ণ অজু করে মোজা পরিধান করে অতপর সে মাজুর (অসুস্থ কিংবা অক্ষম) হয়ে যায়, তাহলে সে মুকিম হলে এক দিন এক রাত পর্যন্ত সুস্থ ব্যক্তির মতো মাসেহ করতে পারবে।
ছয়. চামড়ার মোজার ওপর মাসেহ জায়ে। কিন্তু চামড়া ছাড়া সুতা বা পশমের তৈরি যেসব মোজা সচরাচর পাওয়া যায় এর ওপর মাসেহ সহিহ নয়। তবে সুতা বা পশমের মোজায় নিম্নোক্ত শর্ত পাওয়া গেলে তার ওপর মাসেহ জায়েজ। শর্তগুলো হচ্ছে-
ক. মোজা এমন মোটা ও পুরু হওয়া যে, জুতা ছাড়া শুধু মোজা পায়ে দিয়ে তিন মাইল পর্যন্ত হাঁটা যায়। এতে মোজা ফাঁটে না এবং নষ্টও হয় না।
খ. পায়ের সঙ্গে কোনো জিনিস দ্বারা বাঁধা ছাড়া তা লেগে থাকে এবং তা পরিধান করে হাঁটা যায়।
গ. মোজা এমন মোটা যে, তা পানি চোষে না এবং তা ভেদ করে পানি পা পর্যন্ত পৌঁছায় না।
ঘ. তা পরিধান করার পর মোজার ওপর থেকে ভেতরের অংশ দেখা যায় না।
সচরাচর ব্যবহৃত সুতা বা পশমের মোজায় যেহেতু এসব শর্ত পাওয়া যায় না তাই এর ওপর মাসেহ জায়েজ হবে না।
সাত. প্লাস্টার বা ব্যান্ডেজের ওপর মাসেহ করে এবং অন্য পা ধুয়ে চামড়া জাতীয় মোজা পরা হলে পরবর্তী অজুর সময় থেকে ওই মোজার ওপর মাসেহ করা যাবে। মাসেহের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে উভয় মোজা খুলে পুণরায় ব্যান্ডেজের ওপর মাসেহ করে নেবে এবং অপর পা ধুয়ে নেবে।
তবে অজুর সময় মাথার ওপর মাসেহের সময় পাগড়ি, টুপি এবং বোরকার ওপর মাথা মাসেহ করা জায়েজ নেই। এক্ষেত্রে খালি মাথা মাসেহ করতে হবে, অনুরূপভাবে হাতমোজার ওপর মাসেহ করা জায়েজ নেই।