লাইফ সাপোর্ট দেওয়া ইসলামি শরিয়তে জায়েজ কিনা? ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে কোনো রোগীকে যদি লাইফ সাপোর্ট দেওয়া না যায়, আর তিনি মারা যান তাহলে সংশ্লিষ্ট লোক গোনাহগার হবেন কিনা? কিংবা রোগী লাইফ সাপোর্টে আছেন, এটা কতদিন থাকবে অথবা লাইফ সাপোর্ট রাখা না রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়া পাপের কাজ কিনা? এমন প্রশ্ন প্রায়ই আসে। বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা দরকার।
আলোচনার শুরুতে একটি কথা বলে রাখা দরকার, ইসলামে চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সা.) অনেক হাদিসে পরিষ্কার ভাষায় চিকিৎসা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা করবে। কারণ আল্লাহতায়ালা এমন কোনো রোগই সৃষ্টি করেননি যার তিনি প্রতিষেধকও রাখেননি। -সহিহ বোখারি: ২/৮৪৭
নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজেও চিকিৎসা নিয়েছেন, সাহাবিরা চিকিৎসা নিয়েছেন। নবী করিম (সা.) চিকিৎসার জন্য সমর্থন দিয়েছেন। বিভিন্ন বৈধ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ, ওষুধ সেবন ইসলামের দৃষ্টিতে মোস্তাহাব।
এবার আলোচনা করা যেতে পারে লাইফ সাপোর্ট নিয়ে। লাইফ সাপোর্ট হচ্ছে- একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। যখন একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে পারেন না তখন ইনটেনসিভ কেয়ারে লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে রোগীর ব্রেন, হার্ট ও কিডনিসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো তখন সচল থাকে। লাইফ সাপোর্ট না দিলে এসব অঙ্গ কর্মক্ষম থাকবে না। মোটকথা, এটা একজন আশংকাজনক রোগীকে সারিয়ে তোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। কিন্তু এ চেষ্টার শেষ পর্যন্ত সে সম্পূর্ণ সেরে উঠবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকে লাইফ সাপোর্টে থেকে মারাও যান। খুব কম লোকই সেরে ওঠেন। উপরন্তু এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আবার লাইফ সাপোর্ট নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জনও রয়েছে বাজারে। সবমিলিয়ে এটা স্পষ্ট, যে চিকিৎসায় সাধারণত মানুষ সুস্থ হয় তাও যদি কেউ গ্রহণ না করে মারা যায় তবুও সে গোনাহগার হয় না।
সুতরাং লাইফ সাপোর্টে যখন সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম তখন তা না দিলে গোনাহ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, তদ্রূপ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও কোনো রোগীকে যদি লাইফ সাপোর্ট না দেওয়া হয় তাহলে তাতে রোগী বা তার স্বজনরা গোনাহগার হবেন না। তবে ডাক্তাররা যদি বলেন, তাহলে সম্ভব হলে তা করাটাই ভালো।
আরেকটি কথা, মৃত্যুর সংজ্ঞা, কখন কার মৃত্যু হবে এটা নিয়ে ইসলাম সরাসরি কোনো সময় বা লক্ষণ বলেনি। কোরআনে কারিমে কেবল মৃত্যুর অনিবার্যতা এবং সর্বব্যাপিতার কথা বলা হয়েছে। যেমন সূরা ইমরানের ১৮৫ ও আনকাবুতের ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক প্রাণীরই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’
ইসলামে মৃত্যু হলো- দেহ থেকে রুহের বিচ্ছেদ। কিন্তু রুহ কখন দেহ থেকে আলাদা হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হলে নাকি ব্রেন নিষ্ক্রিয় হলে তা নিয়ে কোনো কথা বলা নেই। সুতরাং আধুনিক ফিকাহ একাডেমি, মেডিকেলের চিন্তাবিদ এবং আলেমদের গবেষণায় এ বিষয়গুলোর যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এসেছে।
সুতরাং কখন কাকে মৃত বলা হবে তা স্পষ্ট করেছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন সংস্থা (OIC) ১৯৮৬ সালের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলনে কাউকে মৃত বলার দু’টি মানদণ্ড বর্ণনা করা হয়েছে। এক. হৃদস্পন্দন ও শ্বাসযন্ত্রের কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া, দুই. মস্তিষ্কের অতি প্রয়োজনীয় অংশগুলো অকেজো হওয়া। এমতাবস্থায় ডাক্তার কিংবা চিকিৎসকদের বোর্ড কর্তৃক মৃত্যুর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।
ইসলামের বিধান অনুযায়ী, কোনো রোগীর বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্ভাবনা থাকা পর্যন্ত তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। যদিও আল্লাহতায়ালা তকদিরে মৃত্যুর বিষয়টি লিখে দিয়েছেন। এখন চিকিৎসকদের সম্মিলিত মতামতের পরও রোগীর আত্মীয়দের উচিত নয়, তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার অহেতুক চেষ্টা করা।
লাইফ সাপোর্টের বিষয়টি ইসলামে বৈধ বলা হয়েছে কোরআনে কারিমের দ্বিতীয় সূরা আল বাকারার ১৫৯ নম্বর আয়াতের আলোকে। ওই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিও না।’
সুতরাং লাইফ সাপোর্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে শরিয়তের বাধা নেই। এ বিষয়ে আলেমরা বলেছেন, যদি কোনো রোগী কেবল লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে বাঁচে, তাহলে সাপোর্ট সরানো উচিত হবে না। যখন মস্তিষ্ক পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায় এবং শ্বাস বন্ধ হয়েছে বলে একমত ও নিশ্চিত হওয়া যায় তখন সাপোর্ট খোলা যাবে।
আরেকটি বিষয়, অপারেশনকালে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ায় কোনো দোষ নেই। এ বিষয়েও তার বক্তব্য স্পষ্ট, সাধারণভাবে শরিয়া হুকুম হচ্ছে আল্লাহতায়ালার ওপর আস্থাবান থাকবে। কিন্তু সাময়িকভাবে যদি কেউ অসুস্থ হয় তাহলে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যবস্থা অনুযায়ী সেবা নিতে দোষ নেই। যেহেতু এটির সঙ্গে মানব মর্যাদা রক্ষা করার প্রশ্ন জড়িত, আর মানব মর্যাদা রক্ষার বিষয়েও শরিয়ত যত্নবান।