তাবলিগ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ প্রচার করা, পৌঁছানো। কোনো ব্যক্তির অর্জিত জ্ঞান নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানোর কাজকে পরিভাষায় তাবলিগ বলা হয়। তাবলিগ এক নিরলস সংগ্রাম ও সাধনার নাম। তাবলিগের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো- আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক হওয়া, যাতে তার কাছ থেকে সব সমস্যার সমাধান লাভ করে ইহকাল ও পরকালে শান্তি এবং সফলতা পাওয়া যায়।
ইজতেমা শব্দের অর্থ সমবেত করা, সমাবেশ, সম্মেলন। ধর্মীয় কোনো কাজের জন্য বহু মানুষকে একত্রিত করা। কাজের গুরুত্ব বোঝানো, কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ব্যাপকভাবে এর প্রচার-প্রসারের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে পরিভাষায় ইজতেমা বলা হয়।
১৯২০ সালে দিল্লির মেওয়াত থেকে তাবলিগ জামাতের কাজ শুরু করেন মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনিই বিশ্ব তাবলিগ জামাতের প্রবর্তক। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এর পদক্ষেপ ছিলো, পথভোলা মানুষকে পথের দিকে আহ্বান করা। মানুষকে ইসলামি আদর্শে আদর্শবান করা।
তাবলিগ জামাতের লোকজন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন শহর ও গ্রামে যেয়ে মানুষকে দ্বীনের বাণী পৌঁছায়। এভাবে দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর অন্তরে স্থান করে নেয় তাবলিগ জামাত।
তাবলিগ জামাতের সাথীরা নিজেদের কর্মতৎপরতা পর্যালোচনার জন্য, নিজের জ্ঞানকে আরও বাড়ানোর জন্য, বিভিন্ন স্থানে ও দেশে কীভাবে তাবিলিগের কাজ পরিচালিত হয় তা জানার জন্য, নতুন সাথীদের কাজে অংশগ্রহণের জন্য নিজ নিজ জেলা অথবা মারকাজে সপ্তাহান্তে উপস্থিত হয়ে নিজেদের কর্মতৎপরতা পর্যালোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। এরই বৃহৎ রূপ হলো বিশ্ব ইজতেমা।
১৯৬৩ সাল থেকে টঙ্গীতে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সে হিসেবে এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৫৭তম ইজতেমা। ২০১০ সাল পর্যন্ত ইজতেমা তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত হতো। পরে মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ২০১১ সাল থেকে দুই দফায় অনুষ্ঠিত হতো ইজতেমার আয়োজন। কিন্তু তাবলিগের মুরব্বিদের বিরোধের কারণে ২০১৯ সাল থেকে দুই পক্ষ পৃথক তারিখে আয়োজন করতে শুরু করে। তার ধারাবাহিকতায় এবারও দুই পক্ষ পৃথক তারিখে ইজমেতায় অংশ নেবে।
রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরের ইজতেমায় প্রতি বছর প্রায় ১০০ রাষ্ট্রের মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে তাবলিগের সাথীরা দলে দলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্বীনি দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন মেয়াদে।
বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ-বিদেশের ঈমানদার ত্যাগী আলেম-উলামাদের কাছ থেকে কোরআন ও হাদিসের আলোকে দ্বীনের বয়ান শুনে ঈমান-আমলের দাওয়াত সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়। শুধু ধর্মীয় বয়ান শোনা বা বিশ্ববাসীর শান্তি ও হেদায়েতের জন্য আখেরি মোনাজাতে প্রচুর লোক অংশগ্রহণ করা ইজতেমার উদ্দেশ্য নয়, বরং যাতে বেশি থেকে বেশি জামাত বের হয় এর দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়। যেন প্রতিটি জামাত নির্ধারিত এলাকার প্রতি মসজিদে তিন দিন করে থেকে তাওহিদ, রেসালাত, আখেরাত, ঈমান ও আমলের দাওয়াত দেয়। তাবলিগের চিল্লায় বের হয়ে অনেক খারাপ লোক ভালো হচ্ছে, এর প্রচুর নজির রয়েছে।
দাওয়াতে তাবলিগ ছয় উসূলের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী কাজ পরিচালনা করছে। ছয় উসূল হলো- ১. কালেমা, ২. নামাজ, ৩. ইলম ও জিকির, ৪. ইকরামুল মুসলিমিন, ৫. ইখলাসে নিয়ত এবং ৬. দাওয়াত ও তাবলিগ।
এই কথাগুলো তাবলিগের সাথীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে, বিভিন্ন মেয়াদে (৩ দিন, ৪০ দিন [১ চিল্লা] ও ৩ চিল্লা) গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দরে ঘুরে বেড়ান। তাবলিগের সাথীরা দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদ ও সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াতের শেখেন।
হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও। এ হাদিসের ওপর আমল করে তাবলিগের সাথীরা বিশ্বে ইসলামের এক মহান দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বাড়ছে। প্রচুর মানুষ ইসলামি আদর্শে আদর্শবান হচ্ছে। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ইসলামি বিধানমতো জীবন গড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তাবলিগের এই ধারা অব্যাহত থাকুক অনন্তকাল। বিশ্ব ইজতেমার শুরুলগ্নে এই প্রত্যাশা রইল।