টঙ্গী (গাজীপুর) থেকে: নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দিল্লি নিজামুদ্দিনের মুরব্বি মাওলানা সাদ অনুসারীদের (এতায়াতি) বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছে। আলমি শুরার ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমার চার দিন পর শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) বাদ ফজর থেকে আম বয়ানের মধ্য দিয়ে এই ইজতেমা শুরু হয়।
রোববার (১৯ জানুয়ারি) জোহরের নামাজের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ইজতেমা। ইজতেমায় হেদায়েতি বয়ান ও আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন নিজামুদ্দিনের মাওলানা জামশেদ।
বিশ্ব ইজতেমার আয়োজকদের অন্যতম, তাবলিগ জামাত বাংলাদেশের আহলে শুরা ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম জানান, ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজের শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভি পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারও ইজতেমায় আসছেন না। তবে নিজামুদ্দিন মারকাজের পক্ষ থেকে ৩২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ইজতেমায় এসেছেন। তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে ইজতেমা।
ইজতেমা ময়দানের জিম্মাদার প্রকৌশলী শাহ মহিবুল্লাহ জানান, মাঠে বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকে বয়ান শুরু হয়েছে। শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ান করেন দিল্লির মুফতি ওসমান ও মুফতি আসাদুল্লাহ সুলতানপুরি। শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে অনুষ্ঠিত জুমার নামাজে ইমামতি করেন বংলাদেশের মাওলানা মোশারফ। জুমার আগে সালাতুত তাসবিহ ও ফাজায়েল বিষয়ে বয়ান করেন মুফতি ফয়জুর রহমান।
আলমি শুরার ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ইজতেমার তুলনায় এই ইজতেমায় লোক সমাগম বেশ কম। তবে জুমার নামাজে মুসল্লিদের উপস্থিতি কিছুটা বাড়ে। জুমার নামাজে অংশ নেন- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম, গাজীপুর মেট্রো পুলিশ কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন ও চট্টগ্রাম লালখান বাজার মাদরাসার মুহতামিম মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
বাদ জুমা ময়দানে আম বয়ান করেন নিজামুদ্দিনের মুফতি চেরাগ আলী। বাদ আসর বয়ান করেন বাংলাদেশের খান মো. শাহাবুদ্দিন নাসিম ও বাদ মাগরিব নিজামুদ্দিনের মাওলানা আবদুস সাত্তার।
প্রথা অনুযায়ী ইজতেমার মূল বয়ান উর্দুতে হলেও ইজতেমায় আগত বিভিন্ন দেশের-ভাষাভাষী মুসল্লিদের জন্য বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিকভাবে অনুবাদ করে শোনানোর ব্যবস্থা করা হয়।
ইজতেমার বয়ানে আলেমরা বলেন, দাওয়াতের মেহনত হলো নবুওয়তি মেহনত। এই মেহনত খুলুসিয়াত (একনিষ্ঠতা) ও আজমতের (গুরুত্বের) সঙ্গে যারা পালন করবে, তাদের যেকোনো আমলের ফজিলত বহুগুণ বেড়ে যায়। বয়ানে তাবলিগের ছয় উসুল (মূলনীতি) ঈমান, নামাজ, ইলম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, সহিহ নিয়ত ও দাওয়াতে তাবলিগ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা ও উদ্দীপনামূলক আলোচনা করা হয়। তাবলিগের কাজের স্পৃহা বাড়াতে বিভিন্ন ঘটনা শুনানো (কারগুজারি) হয়।
জুমাপূর্ব বয়ানে বলা হয়, পরকালের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির জন্য আমাদের প্রত্যককে দুনিয়াতে জীবিত থাকা অবস্থায় দ্বীনের দাওয়াতের কাজে জানমাল দিয়ে মেহনত করতে হবে। ঈমান আমলের মেহনত ছাড়া কেউ হাশরের ময়দানে কামিয়াব হতে পারবে না।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মাঠে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকার নিরাপত্তায় ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৯ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা ময়দান সিসি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদ্যরা পর্যবেক্ষণ করছেন। এ ছাড়াও মেটাল ডিটেক্টর, ফুটপেট্রল, মোবাইল পেট্রল ও চেকপোস্টসহ পোশাকে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা ইজতেমা ময়দানের ভেতরে এবং বাইরে দায়িত্ব পালন করছেন। ইজতেমায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব সদস্যরাও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। রয়েছে ইজতেমা কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত সদস্যরা। তারাও লাঠি হাতে মাঠের প্রবেশপথগুলোতে শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছেন। আগত মুসল্লিদের যাতায়াতের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। মাঠের বিভিন্ন পার্শ্বে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প।
তিন মুসল্লির মৃত্যু: ইজতেমায় যোগ দিতে আসা এক মুসল্লি বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন। তার নাম কাজী আলাউদ্দিন (৬২)। তিনি সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার থানার চানপুর গ্রামের মৃত হজরত আলীর ছেলে। এদিকে ইজতেমায় আসার পথে টঙ্গীতে বুধবার রাতে পৃথক দুর্ঘটনায় দুই মুসল্লি মারা গেছেন। তাদের মধ্যে টঙ্গী স্টেশনে রেললাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার টেংরাকান্দি গ্রামের রমজান আলীর ছেলে গোলজার হোসেন (৪০) এবং মন্নু নগর এলাকায় সড়ক পার হওয়ার সময় কাভার্ডভ্যানের চাকায় পিষ্ট হয়ে নরসিংদীর বেলাবো থানার বীরবাগদে গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে সুরুজ মিয়া (৬০) মারা যান।
বিদেশি মুসল্লি: পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়িছে, ইজতেমায় শনিবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বের ৩৩টি দেশের প্রায় এক হাজার ৯ শ’র মতো মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। বিদেশি মুসল্লিদের বৃহৎ একটি অংশ ভারত থেকে আসা। বয়ানের মঞ্চের পেছনে (ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে) বিদেশি মুসল্লিদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মোবাইল চার্জের অস্থায়ী দোকান: ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের জন্য হোন্ডা রোড, ভরান মাজার বস্তি, টঙ্গী বাজার, আশরাফ সেতু মার্কেট, ষ্টেশন রোড, কামারপাড়া রোড, নিউ মন্নু টেক্সটাইলস মিলস, নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস, মিলগেট এলাকায় মোবাইল চার্জের একাধিক দোকান দেওয়া হয়েছে। এসব দোকানে ২০ টাকায় স্মার্টফোন ফুল চার্জ, আর ১০ টাকায় বাটন ফোন ফুল চার্জ করা হয়।
শনিবারের কর্মসূচি: বাদ ফজর পাঁচ কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বয়ান করেন নিজামুদ্দিনের ভাই মুরসালিন। বাদ জোহর মাঠে আম বয়ান করবেন দিল্লির মুফতি রিয়াসত, বাদ আসর বাংলাদেশের মাওলানা মোশাররফ হোসেন ও বাদ মাগরিব দিল্লির মাওলানা জামশেদ।
ইজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার সকাল ১০টায় আলেম-উলামাদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বয়ান অনুষ্ঠিত হবে। ইজতেমার ময়দানে বয়ানের মিম্বরে এই বয়ান অনুষ্ঠিত হবে ছোট মাইকে। তখন মাঠের মাইক বন্ধ থাকবে। আলেমদের বয়ান চলাকালে ময়দানে তালিমের আমল চলবে। এই বয়ান চলবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত।
আলেমদের উদ্দেশ্য আজ বয়ান করবেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা আব্দুস সাত্তার। বয়ানটি উর্দু ভাষায় হবে। এর কোনো বাংলা তরজমা করা হবে না।