সাড়ে ৪ বছর খতিবহীন জাতীয় মসজিদ

ইসলামি খবর, ইসলাম

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম | 2023-09-01 23:28:23

একটা সময় ছিলো, জাতীয় মসজিদের (বায়তুল মোকাররম) খতিব বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যু ও সংকটে ধর্মীয় সমাধান দিতেন। দেশবাসী থেকে শুরু করে সরকার ও প্রশাসন তা মেনে নিতেন। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা না থাকলেও খতিব সাহেবকে দেশের মানুষ সর্ব্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বা অভিভাবক হিসেবে গণ্য করতেন। 

কিন্তু সাড়ে চার বছর ধরে খতিব ছাড়া ভারপ্রাপ্ত খতিব দিয়ে চলছে বায়তুল মোকাররম। খতিব প্রফেসর মাওলানা সালাহউদ্দিন অসুস্থ হওয়ায় গত সাড়ে চার বছর ধরে সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান, পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মুহিবুল্লাহিল বাকী, মাওলানা মুহাম্মদ এহসানুল হক ও মাওলানা মুহাম্মদ মহিউদ্দিন কাসেমি বায়তুল মোকাররমে জুমার খুতবা দিয়ে আসছেন।

কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে, দায়িত্ব নিয়ে কোনো ধর্মীয় বিষয়ে কিংবা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মতামত তারা জানান না। ফলে একদিকে মানুষ ধর্মীয় বিষয়ে জানার সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যদিকে যোগ্যতর কেউ ধর্মীয় বিষয়ে মতামত না জানানোর সুযোগে অযোগ্যরা মতামত প্রকাশ করছে। ফলে সমাজে নানাবিধ বিতর্ক দেখা দিচ্ছে।

জুমার খুতবায় বিভিন্ন ধর্মীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যের কারণে দেশের প্রধান এই মসজিদের খতিবের পদটি বেশ মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক মেধা, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ গুণের কারণে আলেম-উলামা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ২৪ বছর টানা খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালের রমজান মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন।

সমকালীন সময়ে উদ্ভুত নানা বিষয়ে দিক-নির্দেশনামূলক জুমাপূর্ব বক্তব্য ও খুতবার জন্য জাতীয় খতিব ও শীর্ষ ধর্মীয় নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। তার বক্তব্য শোনার জন্য শুক্রবার দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররমে ভিড় জমাতেন। নানা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

তার মৃত্যুর পর সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা নূর উদ্দিন ভারপ্রাপ্ত খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি খতিব হিসেবে নিয়োগ পান মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল, মহাখালী মসজিদে গাউসুল আজমের খতিব প্রফেসর মাওলানা সালাহউদ্দিন। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে মাদরাসা-ই-আলিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে একই মাদরাসার হেড মাওলানা হিসেবে বিদায় নেন।

২০০৯ সালে তার নিয়োগের পর পক্ষে-বিপক্ষে বায়তুল মোকাররমে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। তখনকার সিনিয়র পেশ ইমাম ও ভারপ্রাপ্ত খতিব মাওলানা নূর উদ্দিনকে খতিব করার দাবিও ওঠে। এ নিয়ে পর পর কয়েক জুমার নামাজে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যে মাওলানা সালাহউদ্দিন খুতবা দেওয়া অব্যাহত রাখলে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে শান্ত হয়। ততদিনে কওমি আলেমদের বড় একটি অংশ বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ বর্জন করা শুরু করেন। মুসল্লি সংখ্যাও কমতে থাকে ধীরে ধীরে।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে খতিব মাওলানা সালাহউদ্দিনের টেলিভিশনে ধর্মীয় আলোচনা নিয়েও নানা সমালোচনা শুরু হয়। সব মিলিয়ে তিনি সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থাভাজন খতিব হিসেবে সেই শ্রদ্ধার জায়গায় পৌঁছতে ব্যর্থ হন। এমন গুমোট পরিস্থিতির মাঝেই মাওলানা সালাহউদ্দিন অসুস্থ হন। এর পর চিকিৎসার জন্য ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৪৫ দিনের ছুটি নেন। সেই থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত।

খতিবের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মাওলানা সালাহউদ্দিন দীর্ঘ দিন ধরে হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী। তারপক্ষে স্বাভাবিক কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভবপর নয়।

সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) ওপর পরিচালিত সরকারি নিরীক্ষায় অনুমোদিতভাবে খতিব সাহেবের কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকার পরও বেতনভাতা পরিশোধের বিষয়টি প্রকাশ পায়। এটা নিয়ে আপত্তি ওঠার পর নতুন খতিব নিয়োগ নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্য কথা বলতে রাজি হননি।

কোনো লিখিত নিয়ম নেই, শুধুমাত্র রীতির কথা বলে বায়তুল মোকাররমে নতুন খতিব দেওয়া হচ্ছে না। সেটা হলো, সাধারণত একজন খতিব বেঁচে থাকা অবস্থায় আরেকজন খতিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু এভাবে দীর্ঘকাল অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও খতিব নিয়োগ না দেওয়ায় এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে বায়তুল মোকাররম মসজিদের কাজে।

সিভিল অডিট অধিদফতর কর্তৃক পরিচালিত বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাড়ে চার বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও খতিব সালাহউদ্দিনের বেতন ভাতা বাবদ ২৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল তাকে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি মঞ্জুর করেন। সে হিসেবে ৩০ সেপ্টেম্বর ছুটি শেষে তার কাজে যোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি আর কাজে যোগ দেননি। এরপরও তাকে নিয়মিত বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। খতিবের স্ত্রী সুফিয়া আখতার বেতন গ্রহণের কথা বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছেন।

বায়তুল মোকাররমের একাধিক ইমাম নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, খতিব সাহেবের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি অসুস্থ, আমরাই আপাতত দায়িত্ব পালন করছি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাওলানা সালাহউদ্দিনের অসুস্থতার কারণে ২০১৬ সালেই নতুন খতিব নিয়োগ দেওয়ার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন বেশ কয়েকজনের নামও আলোচনায় এসেছিল। তখন নতুন খতিব নিয়োগের ব্যাপারে কোনো কোনো মহল থেকে আপত্তি তুলে বলা হয়, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে খতিবদের আমৃত্যু খতিব থাকার রেওয়াজ রয়েছে। ফলে বর্তমান খতিব জীবিত থাকাবস্থায় নতুন খতিব নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না। তবে এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়োগবিধিতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। খতিব নিয়োগের বিষয়টি সরাসরি ধর্ম মন্ত্রণালয় দেখে। দায়িত্ব পালন না করেও বেতন নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসার খতিব নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গেছে।

গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব আল্লামা মাহমুদুল হাসান, গওহরডাঙ্গা মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা মুফতি রুহুল আমিন ও শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ, সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান ও পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মুহিবুল্লাহিল বাকী নদভীর নাম আলোচনায় রয়েছে নতুন খতিব হিসেবে।

সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের ওপর। কিন্তু সাধারণ মুসল্লি ও আলেম-উলামারা বায়তুল মোকাররমের খতিব হিসেবে প্রাজ্ঞ, যোগ্য ও বিতর্কহীন কাউকে নিয়োগ দেওয়ার দাবী জানিয়েছেন এবং এটাই তাদের একান্ত চাওয়া। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর