বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এ কারণে যেসব স্থানে সারা বছর জনসমাগম থাকতো সেসব এলাকা এখন লোকশূন্য।
গত ৫ মার্চ সৌদি আরবে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর পবিত্র কাবা ঘরের মূল তাওয়াফের স্থান (মাতাফ) বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূল মাতাফ বন্ধ থাকলেও মসজিদে হারামের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় তাওয়াফ অব্যাহত ছিল। ফাঁকা কাবার ছবি প্রকাশ্যে আসতেই নানারকম আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যদিও পরে মাতাফ বিশেষ এন্টিভাইরাস দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার পর খুলে দেওয়া হয়েছে।
আপাতত কাবার মাতাফ এলাকা এশার নামাজের পর থেকে ফজর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হচ্ছে। উমরা পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত এই অবস্থা বহাল থাকবে। করোনাভাইরাস যাতে না ছড়াতে পারে তার জন্য পূর্ব সতর্কতার অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সৌদি গণমাধ্যম জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, মাতাফের মাকামে ইবরাহিম এলাকাটিতে তাওয়াফকারীরা তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায়সহ দোয়া করে থাকেন। এ ছাড়া পবিত্র কাবার দরজা, হাজরে আসওয়াদ, হাতিমে কাবা ও মাকামে ইবরাহিম কাছাকাছি স্থানে হওয়ায় উমরা যাত্রীসহ তাওয়াফকারীদের ভিড় বেশি থাকে ওই এলাকায়। অনেকে এসব স্থান স্পর্শ করে থাকেন, চুমু দেন। এ কারণেই সতর্কতার জন্য এখনও কাবা ঘর সংলগ্ন এসব এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে।
সৌদি আরব সরকার গত ২৭ ফেব্রুয়ারি উমরা ও ভিজিট ভিসায় সৌদি আরবে প্রবেশ নিষিদ্ধের পর মক্কার বাইরের লোকদের জন্যও উমরা পালন ও মসজিদে নববীতে গমন নিষিদ্ধ করে। এটা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনার মাঝে কিছু সময়ের জন্য পুরো মাতাফ এবং বর্তমানে কাবা সংলগ্ন মাতাফ এলাকার কিছু অংশ ঘিরে রাখার পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে হারামাইন কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত করতে চাইছেন, পবিত্র কাবা, মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববী এলাকায় যেন করোনাভাইরাসমুক্ত থাকে।
এমতাবস্থায় হারামাইন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দিনে ছয়বার মাতাফকে (কাবা চত্বর) ধুয়ে পরিষ্কার করে জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং সুগন্ধি স্প্রে করা হয়। প্রত্যেক নামাজের পূর্বে একবার এবং মাঝরাতে একবার এভাবে মোট ছয় বার কাবা চত্বর পরিষ্কার করা হচ্ছে।
সোমবার (৯ মার্চ) রাতে দেখ গেছে, এশার নামাজের পর কাবা চত্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্তকরণ অভিযানে দেখভাল করছেন হারামাইন শরিফাইন পরিচালনা কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট শায়খ ড. আবদুর রহমান সুদাইস। জীবাণু নিরোধক ওষুধ স্প্রে করে মাকামে ইবরাহিম, হাজরে আসওয়াদ, কাবার গিলাফ ও দরজাসহ কাবার দেওয়াল পরিষ্কার করতে দেখা যায়।
সৌদি আরবে করোনোভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সন্ধানের পর থেকে হারামাইন কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে পবিত্র দুই মসজিদকে জীবাণুমুক্ত রাখতে।
এদিকে সৌদি আরবের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী শেখ ডক্টর আবদুল লতিফ আলে শেখ মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীসহ সৌদি আরবের অন্য মসজিদগুলোর জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব নির্দেশনার অন্যতম হলো—
আজান ও নামাজের মধ্যবর্তী সময় ১০ মিনিটের মধ্যে কমিয়ে আনা; জুমার নামাজ ও খুতবা ১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ করা; আপাতত মসজিদে নফল রোজার ইফতার না করা; মসজিদে ইতিকাফ (রাতে থাকা) না করা; মসজিদে কোনো ধরনের খাবার ও পানীয় না নেওয়া।
এতসব সতর্কতার পাশাপাশি গ্র্যান্ড মসজিদের প্রধান খতিব শায়খ ড. আবদুর রহমান সুদাইস বারবার গণমাধ্যমে এবং বিভিন্ন নামাজের আগে পূর্ব সতর্কতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য ও বিবৃতি দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে তিনি গ্র্যান্ড মসজিদ পরিদর্শনকারীকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি জিয়ারতকারীদের কাছ থেকে সহনশীল আচরণ প্রত্যাশা করেছেন।
করোনা প্রতিরোধে উমরা পালনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞাকে শরিয়তসম্মত উল্লেখ করে শায়খ সুদাইস বলেছেন, সংক্রমণজণিত যেকোনো মহামারি বা রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়লে তা থেকে দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের প্রথম কাজ। সম্প্রতি করোনা ইস্যুতে সৌদি সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা ইসলামি শরিয়তের আইনের সীমানা ও ইসলামি নীতিমালার পরিপন্থী নয়।
সৌদি গণমাধ্যম আল আরাবিয়া সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার কাবা শরিফের জুমার খুতবায় খতিব শায়খ আব্দুল্লাহ আল জুহানি ও মসজিদে নববীর জুমার খুতবায় খতিব শায়খ সালেহ আল বাদিরও প্রধান ইমামের এ মতকে সমর্থন করে জুমার বয়ানে এর যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব তুলে ধরেন।
শায়খ আব্দুল্লাহ আল জুহানি কাবা শরিফে জুমার খুতবায় বলেন, পবিত্র দুই মসজিদের খাদেম বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ও ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমান করোনাভাইরাস প্রতিরোধে উমরা পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে সৌদি প্রশাসনকে যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা শরিয়তের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
করোনাভাইরাসের মতো মারাত্মক মহামারিতে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য মসজিদে হারাম এবং মসজিদে নববি এশার নামাজের ১ ঘণ্টা পর বন্ধ করে দিয়ে ফজরের ১ ঘণ্টা আগে খুলে দেওয়া হচ্ছে। সতর্কতামূলক এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক মনে করেন দুই পবিত্র মসজিদের প্রধান ইমাম শায়খ সুদাইস।
তিনি বলেন, সংক্রামণজনিত যেকোনো ভাইরাস ও রোগব্যাধির প্রভাব থেকে মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ববোধ থেকেই সৌদি সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বের বিদগ্ধ ইসলামি স্কলাররাও বিষয়টি সমর্থন করেছেন।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে দুই পবিত্র মসজিদকে মুক্ত রাখতে উমরা পালন ও জিয়ারতের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অনির্দিষ্টকালের জন্য উভয় মসজিদে ইতেকাফ, বিছানাপত্র বিছানো ও খাবার-দাবার আনা-নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জমজম পানির কুলারগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছে।
-আল আরাবিয়া অবলম্বনে