রমজান মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীজুড়ে নেমে এলো এক আধ্যাত্মিক স্পন্দন। রুহানিয়াতের দোলায় বিশ্বের সকল মুসলমানের চিত্ত হলো আলোকিত। রহমত, বরকত, নাজাতের পয়গান নিয়ে সূচিত হলো আত্মিক ও শারীরিক পরিশুদ্ধির মাস। খোশ আমদেদ মাহে রমজান।
'রমজান হলো আমার উম্মতের মাস', বলেছেন প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেন, 'রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস আর রমজান আমার উম্মতের মাস।'
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রজব মাস জমি চাষ করার, শাবান মাস বীজ বপন করার আর রমজান মাসে ফল লাভ করার অফুরন্ত নেয়ামত পাওয়া যায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা পুরো বছরকেই বিভিন্ন মাসে বিভক্ত করে মানবজীবনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন, যাতে হজ, কোরবানি, রোজা ইত্যাদি আমলের ধারায় প্রতিটি মুসলমান পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা ইসলামের ফল্গুধারায় অবগাহন করতে সক্ষম হয়।
মাহে রমজান তেমনি কল্যাণময় মাস, যার প্রথম দশদিন রহমত, দ্বিতীয় দশদিন বরকত ও শেষ দশদিন নাজাতের আলোয় দীপ্ত। রমজানে আমলের বহুমাত্রিক সুযোগের পাশাপাশি রয়েছে অধিকতর নেকি হাসিলের নিশ্চয়তা। কারণ রমজানে প্রতিটি আমলের সাওয়াব বাড়িয়ে দেওয়া হয় আর রোজাদারের মুখের গন্ধ হয় মেশকে আম্বরের মতো সুগন্ধিময়।
পবিত্র ও বরকতময় এই রমজান মাসেই রয়েছে মহিমান্বিত লায়লাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, শ্রেষ্ঠ। রয়েছে ইতিকাফের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার ইবাদতে নিবিড়ভাবে বিলীন হওয়ার অবারিত সুযোগ।
পবিত্র কোরআন নাজিলের সম্মানিত মাসও রমজান। ফলে আল্লাহর নির্দেশ সম্বলিত আল কোরআনের সঙ্গে মুমিন-মুসলমানের একাত্ম হওয়ার মাসও রমজান।
অতএব, রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান। দিন ও রাতের প্রতিটি ক্ষণ রোজা, নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ, তাহলিলে পরিপূর্ণভাবে রমজানকে উদযাপন করাই প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য। ফরজ, ওয়াজিবের পাশাপাশি সুন্নতের অনুসরণ করে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে সফল করা বিশ্বাসী মুসলমানের একান্ত দায়িত্ব।
রমজানে নির্দেশিত ও পালনীয় ইবাদতের মাধ্যমে শারীরিক কৃচ্ছসাধন যেমন সম্ভব, তেমনি আত্মিক উৎকর্ষ হাসিল করাও সহজ। লোভ, লালসা, কাম, ক্রোধ, অসততা, নির্লজ্জতা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা, পরচর্চা ইত্যাদির কুঅভ্যাস ও রিপুর তাড়না থেকে বাঁচার পথও দেখায় রমজান।
যদিও দুঃখজনকভাবে লক্ষনীয় যে, একদল লোক রোজা রাখার পরেও নানাবিধ অপকর্ম থেকে সরে আসতে পারে না। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ব্যবসায়িক জীবনকে অনাচার ও অপকর্ম মুক্ত রাখতে পারে না। এদের জন্য রয়েছে চরম দুঃসংবাদ। এদের রোজায় পানাহার ত্যাগ করা হয় বটে, কিন্তু রোজার প্রকৃত পরিশুদ্ধি ও কল্যাণ লাভ সম্ভব হয় না।
রোজাকে বলা হয়েছে 'ঢাল স্বরূপ' এবং প্রকৃত রোজার পুরস্কার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা স্বয়ং নিজে দেবেন। অতএব, রোজা অবশ্যই হতে হবে সর্বাঙ্গসুন্দর, ত্রুটি ও দোষমুক্ত, কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনায় সকল প্রকার অপরাধ থেকে পবিত্র, তাহলেই রোজার পূর্ণ সওয়াব এবং রমজানের অফুরন্ত রহমত, বরকত ও নাজাত পাওয়ার আশা করা যায়।
মানুষের চরম সৌভাগ্য যে, তার জীবনকে আলোকিত ও পরকালকে কল্যাণময় করার অবারিত সুযোগ নিয়ে এসেছে রমজান। এই মাসের যাবতীয় নেয়ামতকে সকল প্রকার ত্রুটির ঊর্ধ্বে রেখে পরিপূর্ণভাবে হাসিল করার এই মহার্ঘ সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা ও সফলতা নিহিত। মাহে রমজানের সূচনার এই মুবারক লগ্নে যা স্মরণ রাখা ও অনুসরণ করা সকলের জন্যই অত্যাবশ্যক এবং পুরো মাসকে বিশুদ্ধ আমল ও আখলাকের আলোকে কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থার একনিষ্ঠ অনুসরণের মাধ্যমে প্রতিপালন করে সফলতায় উদ্ভাসিত হওয়াও একান্ত কর্তব্য।
ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় হিজরি সনে রমজান মাসে রোজা পালন ফরজ করা হয়। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে নয়টি রমজান সিয়াম বা রোজা পালন করেছেন। কারণ রমজানের রোজা দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে ফরজ করা হয়েছিল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাদশ হিজরি বছরের রবিউল আউয়াল মাসে ওফাত লাভ করেন।
আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় সাড়ে ১৪০০ বছরের ইতিহাসে ২০২০ সালের মতো এমন অভাবনীয় রমজান মাস আর আসেনি। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রবল আক্রমণের কারণে ধর্মীয় পণ্ডিত ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে সামাজিক দূরত্ব পালন করছে এবং সকল প্রকার ভিড় ও জনসমাবেশ এড়িয়ে চলছে। ফলে মসজিদে গমন সীমিত করা হয়েছে। রমজানের অন্যতম ও বিশেষ বৈশিষ্টপূর্ণ তারাবির নামাজও ঘরে আদায় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এমতাবস্থায় প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর দায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে নিজের ঘরে স্ব স্ব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রমজানের যাবতীয় আমল নিজ দায়িত্বে ঘরে সম্পন্ন করার বিষয়ে। এই বিরূপ পরিস্থিতিতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা অশেষ সুযোগ দিয়েছেন ঘরগুলোকে আমলের মাধ্যমে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করার। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের রোজা, নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, আজকারের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করার এই মহাসুযোগ কাজে লাগাতে হবে। রহমত, বরকত ও নাজাত লাভের মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের হই ও পরকালীন সফলতা অর্জনের এই মহাসুযোগ কাজে লাগানোই হবে বিচক্ষণতার কাজ।
পাশাপাশি নিজের ও সমাজের অন্যান্যদের কল্যাণ কামনায় দোয়া এবং পরিস্থিতির নির্দেশ মেনে সাধ্যমতো দান করার বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে একটি সফল, সার্থক, কল্যাণশীল ও আমলময় রমজান প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর জন্য বিশেষ কাঙ্ক্ষিত বিষয়। অতএব, মাহে রমজান সহিহ-শুদ্ধতায় পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে সকলের জীবনে রহমত, বরকত, নাজাতের নূরানি আলোয় উদ্ভাসিত হোক।