১৪৪১ হিজরি সনের দ্বিতীয় তারাবি আজ। কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অনেক মসজিদে সূরা তারাবি হলেও বেশ কিছু মসজিদে এবং যেসব বাসা-বাড়িতে কোনো হাফেজ আছেন সে সব বাসা-বাড়িতে খতমে তারাবি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
খতমে তারাবিতে হাফেজ সাহেবরা আজকে সূরা বাকারার ২০৪ নম্বর আয়াত থেকে সূরা আলে ইমরানের ৯১ নম্বর আয়াত পর্যন্ত তেলাওয়াত করবেন।
তেলাওয়াতকৃত এই অংশের মধ্যে অতিব গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের রয়েছে। এসব বিষয়ের অন্যতম -হলো নারী অধিকারের মূলনীতি। সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নারী অধিকারের মূলনীতি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করছেন, ‘স্ত্রীর অধিকার স্বামীর কর্তব্যে আছে, যেভাবে স্বামীর অধিকার স্ত্রীর কর্তব্যে আছে; তবে স্ত্রীর ওপর স্বামীর সম্মান আছে।’
ইসলাম পূর্বকালে পৃথিবীর কোনো প্রান্তরে স্ত্রীর অধিকার স্বীকৃত ছিলো না। কোথাও স্ত্রীকে মানুষই মনে করা হতো না। আবার কোথাও স্ত্রীকে মানুষ মনে করলেও স্বাধীন মানুষ মনে করা হতো না। বরং স্বামীর ক্রিতদাসী মনে করা হতো। এককথায় স্ত্রীকে সকল অধিকার বঞ্চিত মনে করা হতো। মানব সভ্যতা সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত্র স্ত্রীর অধিকার হরণের এ গুরুতর পাপে নিমজ্জিত ছিল। পরবর্তী এ আধুনিককালে অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে যেয়ে সকল ব্যাপারেই স্ত্রীকে স্বামীর সমান গণ্য করা হচ্ছে।
ইসলাম সকল প্রান্তিকতা মুক্ত বাড়াবাড়ির ও ছাড়াছাড়ির মধ্যমপন্থা নির্দেশ করেছে। ইসলাম স্ত্রীকে অধিকারহীন করেনি আবার সকল ব্যাপারে স্বামীর সমানও করেনি। বরং ইসলামের দৃষ্টিতে স্ত্রীর অধিকার আছে, অনেক ব্যাপারে স্ত্রী স্বামীর সমান হলেও কিছু ব্যাপারে স্ত্রী স্বামীর সমান নয়।
সংসার জীবনে স্ত্রীরও কিছু অধিকার আছে স্বামীর ওপর, আবার স্বামীরও কিছু অধিকার আছে স্ত্রীর ওপর। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কিছু কর্তব্য আছে আবার স্বামীর প্রতি স্ত্রীরও কিছু কর্তব্য আছে। সম্মান উভয়ের আছে। তবে স্ত্রীর ওপর স্বামীর সম্মান।
আর্থসামজিক পরিস্থিতির কারণে স্বামীরা তাদের অধিকারগুলো স্ত্রীদের থেকে জোরপূর্বক হলেও আদায় করে নিতে পারে। কিন্তু স্বামী যদি তার নিজ কর্তব্য পালন না করে, স্ত্রীকে ঠকায়, স্ত্রীর অধিকার হরণ করে তবে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে সাধারণত: স্ত্রীরা তাদের অধিকারগুলো জোরপূর্বক স্বামীদের থেকে আদায় করে নিতে পারে না। এ জন্য স্ত্রীর অধিকারের আলোচনা স্বামীর অধিকারের আলোচনা থেকে অধিক গুরুত্বের দাবি রাখে। আর তাই মহান আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অধিকারের কথা বলতে যেয়ে স্ত্রীর অধিকারের কথা আগে বলেছেন। বর্ণনা ধারার দ্বারা সতর্ক করে দিয়েছেন, স্ত্রীর অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রীর অধিকারের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে, বলেছেন, ‘স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা, তুমি তোমার স্ত্রীকে গ্রহণ করেছো আল্লাহর জিম্মায়। আর তোমার স্ত্রী তোমার জন্য বৈধ হয়েছে আল্লাহর বিধানের কারণে। তার ওপর তোমার অধিকার হলো সে অন্য কাউকে নিজের শয্যাসঙ্গী বানাবে না। আর তোমার ওপর তার অধিকার হলো মানসম্পন্ন আহার ও পরিচ্ছদ।’
একদা এক সাহাবি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কর্তব্যে স্ত্রীর অধিকার কী? তিনি জবাবে বললেন, ‘যখন তুমি খাবে তখন তাকেও খাওয়াবে। যখন তুমি পরিধান করবে তখন তাকেও পরিধান করাবে।’
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘স্ত্রীর জন্য নিজেকে পরিপাটি করে রাখতে পছন্দ করি, যেভাবে আমি চাই সে আমার জন্য সেজে থাকুক। কেননা, মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, স্ত্রীর অধিকার স্বামীর কর্তব্যে আছে, যেভাবে স্বামীর অধিকার স্ত্রীর কর্তব্যে আছে।’
এভাবে কোরআনের অনেক আয়াতে এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক হাদিসে স্ত্রীর অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন, গুরুত্বারোপ করেছেন। সংসার জীবনে স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকেই যখন নিজের কর্তব্যের প্রতি যত্নশীল থাকবে, অপরের অধিকারে প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক থাকবে, কেউ অপরের ওপর নিজের অধিকারের বেশি দাবি করবে না তখন পরিবার হবে জান্নাত।
একটি দল সুন্দরভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য, সুচারুভাবে দলবদ্ধতার লক্ষ্য অর্জনের জন্য পূর্বশর্ত নেতৃত্ব ও আনুগত্য। যদি কোনো দলে নির্ধারিত নেতৃত্ব ও আনুগত্য না থাকে আর দলের সকল সদস্য দল পরিচালনার, সিদ্ধান্ত প্রদানের সমান অধিকারী হয় তবে সে দল শতভাগ ব্যর্থ হবে। সে দলে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে পৃথিবীর সকল দল ও মতের মানুষ একমত। তাই তো নির্ধারিত নেতৃত্ব ছাড়া পৃথিবীতে কোনো সংঘ ও দল নেই। একটি সংসার হলো- দু’জন মানুষের সুদীর্ঘ সময়ের দলবদ্ধযাত্রা। এখন সংসার জীবনে যদি স্বামী-স্ত্রী সমান হয়, কেউ কারও অধীন না হয় তাহলে এ সংসার কিভাবে চলবে, এ সংসার কিভাবে টিকবে, এ সংসারের শান্তি-শৃঙ্খলা কিভাবে নিশ্চিত হবে। সংসার জীবনে স্বামী-স্ত্রীর যে কোনো একজনকে অপরজনের অধীনে যেতেই হবে। এখন কে কার অধীনে যাবে। এ প্রশ্নের মিমাংসা যদি স্বামী-স্ত্রীর ওপর রেখে দেওয়া হয় তাহলে এটাই হবে সংসার ভাঙার বড়ো কারণ। তাই মহান আল্লাহ নিজেই এর মিমাংসা করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘স্বামীরা স্ত্রীদের তত্ত্বাবধায়ক হবে।’ -সূরা নিসা: ৩৪
এ বিষয়টিই তিনি সূরা বাকারার আলোচ্য আয়াতে ইঙ্গিতে বলেছেন এভাবে, ‘তবে স্ত্রীর ওপর স্বামীর সম্মান আছে।’ তাই সংসার জীবনে স্ত্রী স্বামীকে মেনে চলবে। স্বামী হলেন দাম্পত্য জীবনের দলনেতা।
তবে দলনেতাকে নেতৃত্ব চালাতে হবে নেতৃত্বের গুণে। নেতৃত্ব লাভের অর্থ এটা নয় যে, সকল জবাবদিহীতামুক্ত হয়ে যা ইচ্ছা তা-ই করবে। আল্লাহর কাছে সকল কাজের চূড়ান্ত জবাব দিতে হবে। প্রত্যেক দায়িত্বশীল তার দায়িত্বের ব্যপারে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবে। অধীনের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে, সক্ষমতা উপলব্ধি করে, কল্যাণকে সামনে রেখেই দায়িত্বশীলকে দল চালাতে হয়।