চর্চা করলে যেকোনো কিছুই আরও ধারালো এবং জোরালো হয়। অন্যান্য মানবিক গুণাবলির মতো সংযমও চর্চা নির্ভর। মনুষ্যত্ববোধও কিন্তু চর্চার বিষয়। অর্থাৎ পরার্থপরতা, সেবা, সমমর্মিতা ইত্যাদির মিশেলে যে মানবিকতা তৈরি হয় তা আসলে চর্চা করতে করতেই বাড়ানো সম্ভব।
প্রতি বছর রমজান মাস সেই সংযম, সমমর্মিতা, পরার্থপরতার চর্চাকে শানিত করার সুযোগ নিয়ে আসে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবারের রমজান সেই সুযোগকে আরও প্রগাঢ় করে তুলেছে।
সারাদিন না খেয়ে থাকলেই কি প্রকৃত রোজা হয়? প্রয়োজন আত্মশুদ্ধির আপ্রাণ চেষ্টা। রমজানের প্রতিটি দিন কীভাবে অতিবাহিত করলে ভালো হয় তার একটি রুটিন থাকা দরকার সবারই। গৃহকর্মী ও অধীনস্থদের নিয়ে পরিবারের সবাই একসঙ্গে ইফতার করার এখন ভালো সুযোগ রয়েছে। সেই সাথে আল কোরআনের বাংলা মর্মবাণীতে ডুবে যাওয়া যেতে পারে। নিজের বা অন্যের জন্যে বিশেষ কোনো প্রার্থনা থাকলে তা করা যেতে পারে। দোয়া কবুলের এটাইতো শ্রেষ্ঠ সময়। দোয়ায় নিমগ্ন হয়ে মনটাকে শুদ্ধ করার পাশাপাশি দেহটাকে শুদ্ধ করার জন্যে ইফতারে প্রচলিত ভুল খাদ্যাভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।
ইফতারের সময় হলে খেজুর খেয়ে পানি পান করাই যথেষ্ট। এতে শরীরে আসবে তাৎক্ষণিক প্রাণশক্তি। চিনির শরবতেরও প্রয়োজন হবে না। মাগরিবের নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলেই সব দিক থেকে ভালো হয়। এতে খরচ কমবে। দেহ অতিরিক্ত খাবারের চাপ থেকে বেঁচে যাবে। রাতের খাবারে ভাত, শাকসবজি, মাছ বা মাংস বা ডিম ও ডালসহ অন্যান্য সুষম খাবার, সালাদ, লেবু, ছোলা ও টক দই থাকা ভালো। পেঁয়াজু, চপ, বেগুনি, পাকোড়ার মতো ভাজাপোড়া না খেলেই বরং ভালো। কারণ এতে হজমের অসুবিধা, বুক জ্বালাপোড়া ও এসিডিটির সমস্যা হতে পারে। পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, মোগলাই, হালিম, চাইনিজ খাবার, গরু ও খাসির গোশত ইত্যাদি এ মাসে যত কম খাওয়া যায় তত ভালো। ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকায় এসময়ে বেশি বেশি ভিটামিন সিযুক্ত ফল খাওয়া উচিত। এতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
সাহরিতেও খাদ্যাভ্যাস সঠিক হওয়া আবশ্যক। প্রোটিন পানির তৃষ্ণা বাড়ায়। সাহরিতে তাই মাছ-মাংস বর্জন করাই স্বাস্থ্যসম্মত। খিচুড়ি, ডিম, ডালেও যেহেতু প্রোটিন আছে তাই এগুলোও না খাওয়া ভালো। অল্প পরিমাণ ভাত-সবজি বা কলা-খেজুর বা দই-চিড়া খেলে সারা দিন শরীর খুব ঝরঝরে থাকবে। তবে একেবারে কিছুই না খাওয়া, অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে সাহরি বর্জন ঠিক নয়।
সারাদিন আরও কিছু বিষয়ের অনুশীলন আমাদেরকে যথেষ্ট পরিশুদ্ধ ও মানবিক করবে। গীবত, পরচর্চা ও অপ্রয়োজনীয় কথা এবং বিতর্ক ও বিবাদ ইত্যাদি থেকে নিজে বিরত থাকা। অন্যরা করলেও তাতে সায় না দেয়া। আমরা যত স্রষ্টা সচেতন হবো, যত অনুভব করবো যে প্রভু আমাকে পাঠিয়েছেন সৃষ্টির কল্যাণে কিছু দায়িত্ব পালনের জন্যে এবং সেই প্রভুর কাছেই আমরা ফিরে যাবো; তত আতঙ্ক থেকে ও শোষকদের নেতিবাচক প্রচারণা থেকে মুক্তি পাবো।
আমরা সবাই মিলে আমাদের সামর্থ্য অনুসারে যদি দান করি ও সঙ্ঘবদ্ধভাবে দান সংগ্রহ করি, তাহলে খেটে খাওয়া মানুষদেরকে এই সময়ের দুর্গতি থেকে হয়তো রক্ষা করতে পারবো। রক্ষা করতে পারবো সমাজকে চলমান অমানবিকতা থেকে।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, জাতীয় এই দুর্যোগের সময় করোনা রোগীদের নিয়ে অনেকেই খুব অমানবিক আচরণ করছে। বাসা থেকে বের করে দেওয়া, মারা গেলে খাটিয়ায় বহন করতে না দেওয়া, মৃতকে কবরস্থানে জায়গা দিতে না চাওয়া ইত্যাদি কোনোভাবেই মানুষের আচরণ হতে পারে না। কিন্তু এগুলো কেন হচ্ছে?
আমাদের স্বার্থপরতা, অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তি, ভীতি, ও ভোগবাদী মনোভাবের জন্যেই এমন হচ্ছে। সময় এসেছে, কীভাবে এগুলো মন থেকে দূর করে মানুষের মতো আচরণ করা যায়, তা নিয়ে ভাবার।
রমজানের প্রতিটি দিন যখনই সময় পাওয়া যায় কোরআনের জ্ঞানে নিজেকে জ্ঞানী করতে পারাই বুদ্ধিমানের কাজ। কোরআনের মাঝে ডুবে গেলে করোনাতঙ্ক দূর হয়ে যাবে। আর টিভি, ইউটিউব, ফেসবুক দেখে সময় কাটালে আতঙ্ক ও অমানবিকতা বাড়বে। ফলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে, নষ্ট হবে রোজার গুণমান, সৃষ্টি হবে নেতিবাচকতা। বরং মানুষ যখন করোনা নিয়ে আতঙ্কিত তখন তাদের মনে আশাবাদ ও ইতিবাচকতা সঞ্চার করে উজ্জীবিত করা গেলে তা হবে অত্যন্ত সময়োপযোগী সৎকর্ম।
জীবিকার সংগ্রামে নামা মানুষগুলোর পাশে সমমর্মিতা নিয়ে দাঁড়ানো গেলে তা হবে গৌরবের কাজ। একাত্তরে যেমন গভীর মমতা নিয়ে সবাই সবার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, এখনও তেমনি সবার পাশে দাঁড়ানোর সময়। যে গৃহকর্মী কাজ হারিয়েছেন, যে দিনমজুর কাজ পাচ্ছেন না, যে রিকশাওয়ালা উপার্জন করতে পারছেন না তাদের পাশে এখন দাঁড়ানোর সময়।
আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার যে, রমজান খাদ্য সংযমের মাস, খাদ্য উৎসবের নয়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সমাজের যে বিপুলসংখ্যক মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন, অন্নহীন হয়ে পড়েছেন তাদের প্রতি সমবেদনা জানাতে আমরা রমজানে নিজেদের খাবার খরচ একটু কমিয়ে ফেলতে পারি কিনা ভাবতে হবে। ঈদের কেনাকাটায় খরচ একটু কমিয়ে ফেলতে পারি কিনা দেখতে হবে। সেই অর্থটুকু কোনো দরিদ্র পরিবারে বা দুস্থ এতিম শিশুদের জন্যে ব্যয় করতে পারি কিনা তা চিন্তা করতে হবে। নামি-দামি হোটেলের খাবার বর্জন করার ভেতর দিয়ে শুরু হতে পারে আমাদের সেই মানবিক প্রচেষ্টা। তাহলেই আমরা রমজানের মূল চেতনা ‘সংযম’কে ধারণ করে মানবিকতার বিকাশ ঘটাতে পারবো।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা: সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি