চলতি রমজানের ৮ম তারাবিতে তিলাওয়াত করা হবে ১১ নম্বর পারা অর্থাৎ সূরা তওবার ৯৪ নম্বর আয়াত থেকে সূরা হুদের ৫ নম্বর আয়াত পর্যন্ত। আজকের তেলাওয়াতের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো- মুসলিম সমাজের কিছু প্রতিভাবান মেধাবীকে অন্য সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে নিরেট দ্বীনী জ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় নিয়োজিত রাখার নির্দেশ।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিমদের পক্ষে এটাও সমীচীন নয় যে, তারা (সর্বদা) সকলে এক সঙ্গে (জিহাদে) বের হয়ে যাবে। সুতরাং এমন কেন হয় না যে, তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে একটি অংশ বের হবে, যাতে (যারা জিহাদে যায়নি) তারা দ্বীনের উপলব্ধি অর্জনের চেষ্টা করে এবং যখন তাদের কওমের (সেই সব) লোক (যারা জিহাদে গিয়েছে, তারা) তাদের কাছে ফিরে আসবে, তখন তারা তাদেরকে সতর্ক করে, ফলে তারা (গোনাহ থেকে) সতর্ক থাকবে।’ -সূরা তওবা: ১২২
জ্ঞান চর্চা ইসলামের এবং ইসলামি রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক কর্মসূচি। মানুষের জীবনের বড়ো অংশ দু’টি। দুনিয়া ও আখেরাত। ইসলাম মানুষের উভয় জীবনের সুখ, শান্তি, সফলতা ও উন্নতি কামনা করে। তাই মানুষের উভয় জীবনের সুখ, শান্তি, সফলতা ও উন্নতির জন্য যতগুলো শাস্ত্রের জ্ঞান চর্চা দরকার ইসলাম সেই সমুদয় শাস্ত্রের জ্ঞান চর্চাকের উৎসাহিত করে এবং ইসলামি রাষ্ট্র সেই সব শাস্ত্রের জ্ঞান চর্চা ও গবেষণাকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। তাই তো মহানবী সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে বিদেশি ভাষা শিখা হতো। তরুণ সাহাবাগণ প্রবীণ সাহাবাদের থেকে সাহিত্য, ব্যবসায়, হস্তশিল্প, কৃষি শিখতেন। সাহাবাদের পরবর্তীতে বিভিন্ন খেলাফত আমলের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়গুলোতে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতির প্রয়োজনীয় সকল শাস্ত্রের চর্চা ও গবেষণা হতো।
ইসলাম মানুষের উভয় জীবেনর সুখ, শান্তি, উন্নতি, সফলতার প্রতি গুরুত্বারোপ করলেও সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে থাকে মানুষের পরকালীন জীবনের সফলতা ও সুখের প্রতি। তাই সঙ্গত কারণেই উভয় জীবনের জ্ঞান চর্চার প্রতি ইসলামের গুরুত্বারোপ থাকলেও ইসলামের সর্বাধিক সর্বাধিক গুরুত্বারোপ থাকে দ্বীনী জ্ঞানের চর্চার ও গবেষণার প্রতি।
একজন মানুষের জীবনে বহু শাস্ত্রের দরকার আছে। সে অসুস্থ হলে, কর্মক্ষম থাকতে হলে চিকিৎসা শাস্ত্র তার দরকার, বাসস্থানের জন্য স্থাপত্য শাস্ত্র দরকার, পোশাকের জন্য শিল্প শাস্ত্র দরকার, খাদ্যের জন্য কৃষি শাস্ত্র দরকার। কিন্তু মানুষের সামর্থ্য সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ মানুষ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয় না। একজন মানুষ বহু শাস্ত্রে অবদান রাখতে পারে না, বহু শাস্ত্র নিয়ে জ্ঞান-গবেষণা করতে পারে না। তার এ সীমাবদ্ধতার কথা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন। তাই তিনি কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। সমাজের সবাই চিকিৎসক হবে, সবাই প্রকৌশলী হবে, সবাই কৃষিবিদ হবে, সবাই ফতিহ হবে- এটা আল্লাহ চাননি। তাই তিনি সমাজের কিছু মানুষকে দ্বীনী জ্ঞানে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য অবসর থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিছু মানুষকে ধর্মীয় জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হতে আদেশ করেছেন। তারা দিন-রাত, জীবন-যৌবন দ্বীনী জ্ঞানের জন্য দান করে দিবে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মসজিদের বারান্দায় দ্বীনী জ্ঞানের জন্য নিবেদিত একদল মানুষ পড়ে থাকতেন। যারা কোরআন-হাদিস মুখস্ত করা ছাড়া আর কিছুই করতেন না। তাদের একজন হলেন সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাাকারী হজরত আবু হুরায়রা (রা.)। একদা প্রবীণ এক সাহাবি বললেন, আমরা সুদীর্ঘকাল নবীজির সান্নিধ্য পেয়ে এতো হাদিস বর্ণনা করতে পারি না যত হাদিস হজরত আবু হুরায়রা (রা.) অল্পদিনের সান্নিধ্যে বর্ণনা করেন। তখন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, আমার মুহাজির ভাইয়েরা দিনে ব্যবসার কাজে বেরিয়ে যেতেন, আনসার ভাইয়েরা দিনে কৃষি কাজে বেরিয়ে যেতেন। আমি না ব্যবসায় যেতাম, না ক্ষেতে যেতাম। আমি তো দিন-রাত মসজিদে পড়ে থেকে হাদিস মুখস্ত করতাম।
কোনো শাস্ত্রের ওপর বিশেষায়িত ও অতি বিজ্ঞ লোক ছাড়া কোনো শাস্ত্র পৃথিবীতে টিকে থাকে না, থাকতে পারে না। ইসলাম টিকিয়ে রাখতে চাইলে প্রতিটি যুগেই ইসলামের ওপর বিশেষায়িত অতি বিজ্ঞ লোক সৃষ্টি করতেই হবে। এ জন্যই তো উপরোক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘সুতরাং এমন কেন হয় না যে, তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে একটি অংশ বের হবে, যাতে তারা দ্বীনের উপলব্ধি অর্জনের চেষ্টা করে।’
এখানে একটি বাস্তব প্রশ্ন চলে আসে তাহলে এরা চলবে কিভাবে, এদের সংসার চলবে কিভাবে। এর উত্তর ইসলামে সহজ। ইসলামি খেলাফত রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে তাদের বৃত্তি দিবে। আর যখন খেলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকবে না, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং কোরআন-সুন্নাহর প্রতি অনুগত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকবে না তখন মুসলিম জনসাধারণ নিজেরা মিলে নিজেদের দ্বীনের স্বার্থে সামাজিকভাবে দ্বীনী জ্ঞান চর্চার ও গবেষণার দায়িত্ব নেবে।
আরেকটি প্রশ্নও স্বাভাবিকভাবে চলে আসে, দ্বীন জ্ঞান চর্চায় ও গবেষণায় যারা নিয়োজিত নিবেদিত থাকবে খেলাফত রাষ্ট্র অথবা মুসলিম জনসাধারণের সমাজ যাদের দায়িত্ব নেবে তারা খেলাফত ও মুসলিম সমাজকে কী দেবে? এ প্রশ্নের উত্তরও উপরোক্ত আয়াতে দেওয়া আছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যখন তাদের কওমের (সে সব) লোক (যারা জিহাদে গিয়েছে, তারা) তাদের কাছে ফিরে আসবে, তখন তারা তাদেরকে সতর্ক করে, ফলে তারা (গোনাহ থেকে) সতর্ক থাকবে।’ অর্থাৎ যারা জ্ঞান চর্চায় নিবেদিত না, মানুষের, সমাজের, উম্মাহর, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অন্যান্য কাজে নিয়োজিত আছে, ব্যস্ত আছে তারা যখন কাজ থেকে অবসর হবে তখন আলেমরা তাদেরকে দ্বীনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান শেখাবে, তাদের পেশাগত কাজে, ব্যক্তিগত জীবনে যে সব দ্বীনী ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে সেগুলোর ব্যপারে আলেমরা তাদের শতর্ক করবে। আর তাদের জন্য অপরিহার্য আলেমদের দ্বীনী পরামর্শ মেনে নিয়ে আলেমদের কথা মতো নিজেদের শুধরে নেওয়া।
আলেমরা চিকিৎসকদের পরামর্শ দেবেন, তারা জনগণকে চিকিৎসা সেবা দিতে যেয়ে কোথায় কোথায় দ্বীনী ভুল করছেন, কিভাবে তা শোধরাতে হবে। আলেমরা প্রকৌশলীকে পরামর্শ দেবেন, তারা জনগণকে সেবা দিতে যেয়ে কোথায় কোথায় কী কী দ্বীনী ভুল করছেন, তা থেকে উত্তোরণের উপায় কী। একজন সৈনিক তার সেনা জীবনে কী কী ধর্মীয় ভুল করছেন আলেমরা তা বলে দেবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে যেয়ে কোথায় কোথায় দ্বীনী সমস্যা সৃষ্টি করছেন আর তার সমাধান কী হবে তা আলেমরা তাদের বলে দিবেন। এভাবে সমাজের প্রয়োজনে সৃষ্টি হওয়া সাংবাদিক, ব্যাংকার, কৃষক, ব্যবসায়ীসহ সকল পেশাজীবীদের দায়িত্ব পালনে দ্বীনী সাপোর্ট করাই আলেমদের দ্বীনী দায়িত্ব।
মোটকথা, মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার ও গবেষণার একটি স্বতন্ত্র শ্রেণি থাকতে হবে। তবে অন্যান্য ধর্মের মতো এ শ্রেণি জন্মগত হবে না, বংশগত হবে না। যেকোনো বংশের, যেকোনো পরিবারের জন্য আলেম শ্রেণিভুক্ত হওয়ার দরজা সবসময় উন্মুক্ত। কিন্তু কথা হলো- আলেম শ্রেণিভুক্ত হতে হলে যথা নিয়মে, পূর্ববর্তী আলেমদের দীর্ঘ সান্নিধ্যে থেকে তাদের নিবিড় পরিচর্যায় থেকে নিজেকে আলেমরূপে তৈরি করার কঠোর সাধনায় ব্রত হতে হবে। আর বাকি তামাম মুসলমান এ আলেম শ্রেণির পরামর্শ ও সতর্কবার্তা গ্রহণ করবে।