পবিত্র কোরআনের মূল বিষয়বস্তু হলো হেদায়েত ও পথনির্দেশনা। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি যতো জ্ঞান এবং বিজ্ঞান রয়েছে, কোরআন এগুলোর সাংঘর্ষিক নয় এবং এগুলোও কোরআন বিরুদ্ধ নয়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে রোজার যেই উপকারিতা এবং কার্যকারিতা রয়েছে কোরআনে সেই আলোচনা না এনে আল্লাহতায়ালা এক কথায় বলে দিয়েছেন, রোজার মধ্যে প্রভূত কল্যাণ রয়েছে।
আপনি যদি একজন বাস্তববাদী মানুষ হতে চান, তাহলে আল্লাহতায়ালা আপনাকে পথ দেখাবেন এবং গবেষণার ক্ষেত্রে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। আধুনিক এবং প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞান এ ব্যাপারে একমত যে, রোজা শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম নিরাময় এবং মানবদেহের জন্য সেরা প্রতিষেধক। তাছাড়া পুরো উম্মাহর মধ্যে সামরিক সাহস এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মনোভাবকে সতেজ করে তোলে রোজা। এদিক থেকে রমজানের রোজা বার্ষিক অনুশীলনের একটি দূর্দান্ত ব্যবস্থাপত্র।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরর রোজার আরও কিছু অভাবনীয় কল্যাণ ও উপকারিতা খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো হলো-
ত্রুটিযুক্ত কোষ থেকে মুক্তি: রোজা রাখার ফলে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোতে দারুণভাবে এর প্রভাব পড়ে। যা দুর্বল কোষগুলো সহ্য করতে না পেরে তা ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে শরীরে থাকা ত্রুটিযুক্ত কোষ থেকে মানুষ মুক্তি লাভ করে।
শারীরিক বৃদ্ধি: রোজার কারণে যে প্রচণ্ড ক্ষুধার সৃষ্টি হয়, এর দ্বারা শরীরে থাকা অতিরিক্ত মেদ, আর্দ্রতা এবং চর্বি অপসারিত হয়। যা অবসাদ দূর করে শারীরিক বৃদ্ধি এবং বিকাশে সহায়তা করে।
মানসিক প্রাণশক্তি: রোজার সময় স্বাস্থ্যকর এবং শক্তিশালী খাবার গ্রহণ রক্ত চলাচলের উন্নতি ঘটায়। যা মস্তিষ্ককে ভালো এবং প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন এবং সুগার সরবরাহ করে।
সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা: রোজা রাখলে হজম প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি অগ্ন্যাশয়কে স্বস্তি দেয়। অগ্ন্যাশয়ের কাজ হলো শরীরে ইনসুলিন সরবরাহ করা। আর ইনসুলিনের কাজ হলো খাদ্য থেকে অর্জিত সুগারকে চর্বিতে রূপান্তর করা। মানুষ যখন প্রয়োজন অতিরিক্ত ভক্ষণ করে তখন শরীরের ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, যা অগ্ন্যাশয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং এটি তার প্রাকৃতিক কার্যকারিতার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটিয়ে রক্তের মধ্যে সুগারের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ফেলে। সুগারের রোগী যখন রোজা রাখে, তার খাবার নিয়ন্ত্রণ করার কারণে অগ্ন্যাশয় থেকে মুক্তি পাওয়া ইনসুলিন সহজেই চর্বিতে রূপান্তর হয় এবং সুগার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
রক্তচাপ: অতিরিক্ত চর্বির কারণে ধমনি বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত চলাচলে চাপ পড়ে। যা রক্তচাপের (ব্লাড প্রেশার) রোগ বলে পরিচিত। রোজা রাখার কারণে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমে যায়। যার ফলে ধমনির ওপর চাপ কম পড়ে। এ জন্য রোজা উচ্চরক্তচাপের রোগীদের জন্য একটি কার্যকরি ওষুধ।
ত্বকের রোগে সহায়তা করে: রোজা রক্তে পানির পরিমাণ হ্রাস করে, ফলস্বরূপ শরীরে পানির পরিমাণও হ্রাস পায় যা ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোজা চর্মরোগ ও ফোড়া থেকে বাঁচায়।
হজম প্রক্রিয়া: রোজা হজমযন্ত্রকে স্বস্তি দেয়, যা হজমশক্তি বাড়ায়।
মনস্তাত্ত্বিক উপকারিতা: রোজা শারীরিক অসুস্থতা যেমন নিরাময় করে, তেমনি এটি মানসিক অসুস্থতারও নিরাময়।
রাগ থেকে মুক্তি: শক্তিধর লোকেরা তাদের ইচ্ছা দুর্বলদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান, অন্যায়ভাবে তার ওপরে রাগ ঝাড়েন, কিন্তু রোজার কারণে যখন তিনি ক্ষুধার্ত হন, তখন অন্যের দুর্বলতা অনুভব করে এবং তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন সুতরাং রোজাদার ব্যক্তি কারও সহজে কারও সঙ্গে রাগান্বিত হতে পারেন না।
অনিদ্রা থেকে মুক্তি পাওয়া: যারা প্রচুর কাজ করেন। কৃষি কাজ কিংবা অন্যান্য কঠোর কোনো পরিশ্রমের কাজ, তারা কখনই অনিদ্রায় ভোগেন না। তারা সর্বদা শান্তিতে ঘুমান। ঠিক তেমন যারা রোজা রাখেন, তারাবি পড়েন, কোরআন তেলাওয়াত করেন, তাদেরও অনিদ্রা হয় না; শান্তির ঘুম হয়।
ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধি: রোজা অবস্থায় একজন মানুষ ধৈর্য্যের মতো কঠিন একটি গুণের অনুশীলন করেন, যা চেতনা উন্নত করে, চিন্তাভাবনা এবং ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ঘটায় এবং দীর্ঘস্থায়ী ঝামেলা ও কষ্টে অভ্যস্ত করে তোলে।
ধূমপান এবং মাদক থেকে মুক্তি লাভ: অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের তুলনায় একজন মুসলমান রোজাদার ব্যক্তির জন্য মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া খুব সহজ। কারণ, তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকেন। এভাবে অনুশীলনের ফলে মাদকাসক্তিও দূর করতে পারেন।
রোজার সামাজিক উপকারিতা: নামাজ মুসলমানদের জন্য যেমন একতার প্রতীক, তেমন রোজাও। রোজা একে অন্যের দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে শেখায়। ধনীকে দরিদ্র, দিনমজুরদের মুখে খাবার তোলে দেওয়ার সবক দেয়। এক সঙ্গে বসা এবং একসঙ্গে খাওয়ার তালিম দেয়। তাইতো রমজানে ইফতারের সময় মসজিদে কিংবা ইফতার মাহফিলে ধনী-গরিব মুসলমানদের একসঙ্গে বসে খেতে দেখা যায়।
শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা: রমজানের বরকতময় সময়গুলো মুসলমানদের অনুশাসনকে আলোকপাত করে। পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানের খাওয়া-দাওয়ার সময় নিয়ন্ত্রিত হয়। যাই ঘটুক না কেন, প্রতিটি মুসলিম শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ এবং নারী, ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি পানাহার থেকে মুক্ত থেকে রোজা পালন করেন। যেসব জিনিস তার রোজার জন্য ক্ষতিকারক সেগুলো এড়িয়ে চলেন এবং দিন পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। মসজিদের মিনার থেকে আজানের তাকবির ধ্বনি শুনলে তখনই রোজা সমাপ্ত করেন।
দরিদ্র ও অভাবী মানুষের অনুভূতি: মানুষ গাফেল জাতি। সবসময় দুনিয়া অর্জনের পেছনে দৌঁড়ায়। নিজের ভালো বুঝে। অন্যের খবর নেওয়ার মতো সময় তার হয়ে ওঠে না। রমজান এলে যখন রোজা রাখে, তখন অভুক্ত লোকদের অনুভূতি ও কষ্ট সে বুঝতে পারে। এই জন্যই রমজানে বিত্তবান শ্রেণির লোকেরা জাকাত এবং সদকার প্রতি ঝুঁকে পড়ে।
অনুবাদ মুহাম্মদ বিন ওয়াহিদ