জাকাত ইসলামের প্রধান আর্থিক ইবাদত। সুষম সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এটি আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি ও ইসলামের মৌল স্তম্ভের উল্লেখযোগ্য একটি। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো নামাজ ও জাকাত।
কোরআনে কারিমের বহু স্থানে নামাজ ও জাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখছেন।’ -সূরা বাকারা: ১১০
কোরআনের অন্যত্র আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো, জাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পারো।’ -সূরা নূর: ৫৬
হাদিস শরিফে জাকাতকে ইসলামের সেতুবন্ধন বলা হয়েছে। কারণ, এটি ধনী ও গরীবের মাঝে অর্থনৈতিক সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে। মুসলিম সমাজ থেকে দরিদ্রতা দূরীকরণে এবং সমাজে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে জাকাতের ভূমিকা অপরিসীম।
জাকাত আদায়ের গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনের বিরাশিটি স্থানে নামাজের পর পরই জাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে আল্লামা তাবারি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জাকাত আদায়ে সম্মত হবে না তার কোনো নামাজই গ্রহণযোগ্য হবে না।’ –তাবারি: ১৪/১৫৩
জাকাত যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ থেকে তা সহজে অনুমেয়। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে জাকাতের প্রচলন অনেক কম। অথচ নামাজ এবং জাকাত উভয়েই সমভাবে ফরজ। একটি হচ্ছে আল্লাহর হক আর অপরটি বান্দার হক।
সূরা নিসার ১৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আজিম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা নামাজ আদায় করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দেবো।’
অন্য আয়াতে জাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনার দোয়া তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ -সূরা তওবা: ১০৩
এ কারণেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম জাকাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন।
হজরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু জাকাতের বিরূদ্ধচারণকারীদেরকে মুরতাদ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! তারা যদি আমাকে ( জাকাতের) একটি উটের দড়িও প্রদান করতে অস্বীকার করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদান করত, আমি তাদের বিরূদ্ধে অস্ত্রধারণ করবো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তা আদায় করে দেয়।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
ইমাম ইবনে হাজার আসকালারি (রহ.)-এর ভাষায়, ‘জাকাত ইসলামি শরিয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলিল-প্রমাণের আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। জাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসয়ালায় ইমামদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ জাকাত ফরজ হওয়া সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। জাকাতের ফরজিয়াতকে যে অস্বীকার করে, সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।’ -ফাতহুল বারি: ৩/৩০৯
জাকাতের উপকারিতা
সম্পদের জাকাত আদায় করা আল্লাহতায়ালার নির্দেশ। আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম। পার্থিব কোনো উপকারিতা থাকুক আর না থাকুক, আল্লাহর নির্দেশ পালনে মুমিন সর্বদা বাধ্য। তবে আল্লাহর কোনো নির্দেশই পার্থিব উপকারিতা মুক্ত নয়। তেমনি জাকাতের মাঝেও রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের পাশাপাশি পার্থিব অনেক উপকারিতা।
এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোনো অবিশ্বাসী পাপীকে।’ -সূরা বাকারা: ২৭৬
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোনো বান্দা যখন জাকাত আদায় করেন, তখন আল্লাহর আদেশে একজন ফেরেশতা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকেন, হে আল্লাহ! আপনার পথে যে দান-সদকা করে, জাকাত দেয়- তার সম্পদকে আপনি বৃদ্ধি করে দিন, আর যে ব্যক্তি সম্পদ ধরে রাখে (জাকাত দেয় না) তার সম্পদ আপনি ছিনিয়ে নিন।’ –সহিহ বোখারি
জাকাত আদায় করলে বাহ্যিকভাবে মনে হয় সম্পদ কমে যাচ্ছে। কিন্তু জাকাত আদায় করলে আল্লাহতায়ালা অবশিষ্ট সম্পদে প্রভূত বরকত দান করেন, যা জাকাত না দিলে পাওয়া যেত না। আবার জাকাতের মধ্যে যে সম্পদ খরচ হয়, আল্লাহতায়ালা ভিন্ন কোনো উপায়ে সেই সম্পদ আবার ফিরিয়ে দেন।
জাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতি
জাকাত প্রদানে যারা কার্পণ্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন এবং হাদিস শরিফে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তাই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও জমিনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা করো আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত।’ -সূরা আলে ইমরান: ১৮০
হাদিস শরিফে এসেছে, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার জাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ওই ধন, আমিই তোমার পুঞ্জিভূত সম্পদ।’ –সহিহ বোখারি
জাকাত ফরজ হওয়ার শর্তসমূহ
১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া।
২. মুসলমান হওয়া। কোনো কাফেরের ওপর জাকাত ফরজ নয়।
৩. বালেগ হওয়া। কোনো নাবালেগের ওপর জাকাত ফরজ নয়।
৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার ওপর জাকাত ফরজ নয়।
৫. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর ওপর জাকাত ফরজ নয়।
৬. মালের ওপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার ওপর জাকাত ফরজ হয় না।
৭. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া।
৮. নেসাব পরিমাণ মাল এক বছর অতিবাহিত হওয়া।
জাকাত যাদের দেওয়া যাবে
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ -সূরা তওবা: ৬০
জাকাত আদায়ের সময়
জাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে রমজান মাস জাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। রমজানে দান-সদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সওয়াব হয়। তাই পবিত্র রমজান মাসে মুমিন বান্দারা একসঙ্গে গরীবের হক জাকাত ও ফিতরা আদায় করে থাকেন।
দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মাহে রমজানই অধিক সওয়াব প্রাপ্তির জন্য জাকাত আদায়ের উপযুক্ত মৌসুম ও শ্রেষ্ঠতর সময়। রমজান মাসে ধনী লোকেরা দরিদ্রদের জাকাত প্রদানের ফলে উভয় শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠে।
অভাবগ্রস্ত, অসহায়, সম্পদহীন, কর্মহীন, এতিম, বিপদ ও দায়গ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশ হলেও অত্যন্ত বিস্ময়কর এই যে, আমাদের অনেকেই এ ব্যাপারে উদাসীন। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে চান না। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষকে সহায়তা করার মতো মহৎ কাজ বা সৎকর্ম আর কিছু হতে পারে না। বর্তমান বিশ্বে ‘করোনা ভাইরাস’ মানুষকে সাহায্য ও সহায়তা করার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে।
জাকাত, দান ও সদকার অর্থ গরীব-দুঃখী-অসহায়দের মধ্যে বণ্টন করে দিলে দানের সওয়াব যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষ উপকৃত হবে। আমরা আশা করবো- সরকার, মিডিয়া ও আলেম সমাজ বেশি বেশি জাকাত, দান-খয়রাত ও সদকা করার ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেবেন। মনে রাখতে হবে, জাকাত আদায় এবং অভাবী অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক