মাহে রমজানের প্রথম দশক রহমতের কাল পেরিয়ে এখন চলছে মাগফেরাতের দশক। তারপর আসবে নাজাতের শেষ দশ দিন। এভাবেই পুরো রমজান বান্দাকে আমলের ফল্গুধারায় অবগাহনের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার ইবাদতে মগ্ন রাখে।
যদিও করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে ২০২০ সালের রমজান মাসের পরিস্থিতি অতীতের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং আবহাওয়াও গ্রীষ্মের দাবদাহ ও ঝড়বৃষ্টির কারণে খানিকটা উত্তপ্ত ও চঞ্চল, তথাপি মাঝে মাঝেই রহমতের পরশমাখা শীতল বৃষ্টিতে সিক্ত হয়েছে মাহে রমজানের প্রথমার্ধ।
তদুপরি, মৌসুমের কারণে বর্তমানে দিন বড় হওয়ায় এবার সুদীর্ঘ সময় উপবাসের মাধ্যমে রোজাব্রত পালন করতে হচ্ছে। কিন্তু এজন্য কারো বিশেষ কষ্ট বা অভিযোগ নেই। কেননা, মুসলমানগণ যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেও আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনে দৃঢ়প্রত্যয়ী, যা তাদের ঈমান বা বিশ্বাসের অপরিহার্য অংশ।
রোজায় না খেয়ে উপবাস করা হলেও রোজা কেবলই উপবাস বা না খেয়ে থাকা নয়। পানাহার পরিহার তথা উপবাস এবং কাম রিপুর তাড়না থেকে বিরত থাকাও রোজার শর্ত। রোজা পালনের সময় প্রতিটি রোজাদারকে এ কথাও মনে রাখতে হয় যে, খাওয়া-দাওয়া, প্রবৃত্তি, রিপু, খাহেশাত পরিত্যাগের পাশাপাশি সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও রোজায় শরিক করতে হয়। যার মধ্যে জিহ্বা, গোপন অঙ্গ, হাত, পা, চোখ, কান ইত্যাদি সবই রয়েছে।
পবিত্র কোরআনে সূরা নূর, আয়াত ৩০-৩১১-এ স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতায়ালা বলছেন, ‘হে নবী! আপনি মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই হচ্ছে তাদের জন্য উত্তম পন্থা। কেননা, তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে পূর্ণভাবে জানেন। হে নবী! আপনি মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।’
যদিও চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করা কেবল রোজার সময়ের কাজ নয়, বরং মুমিন-মুসলমানের নিজস্ব ঈমান, আমল, আখলাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সারা জীবনের সব সময়ের দায়িত্ব, তথাপি রমজানে চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজতের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পায়। কারণ চোখের হেফাজত হলো- দৃষ্টিকে সংযত ও অশ্লীলতা থেকে নিরাপদ রাখা। তা না হলে চোখের প্ররোচনায় লজ্জাস্থানের হেফাজত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ও শুদ্ধতার সঙ্গে রোজা পালন কঠিন হয়ে পড়ে।
এ কারণে উপবাস বা পানাহার ত্যাগ তথা রসনার রোজার মতো চোখের রোজা হলো হারাম বস্তু থেকে চোখকে সংযত রাখা। অশ্লীল ও নিষিদ্ধ বস্তু না দেখা। চোখের প্ররোচনার কারণে অন্তর ও লজ্জাস্থানকে বিচলিত ও পথভ্রষ্ট না করা। পবিত্র কোরআনের সূরা নূরের ৩০-৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা যে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে তা দৃঢ়ভাবে মান্য করা।
বস্তুতপক্ষে চক্ষু হচ্ছে হৃদয়ের জানালা এবং রূহের দরজা। এ পথ দিয়ে ভালো জিনিস যেমন প্রবেশ করতে পারে, মন্দ জিনিসও প্রবেশ করতে পারে, যা কষ্ট ও শাস্তির কারণ। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখো।’
সহিহ বোখারির ৬২২৯ নম্বরে বর্ণিত এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দৃষ্টিকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যে ব্যক্তি তার দৃষ্টিকে সংযত করবে না, সে চারটি বিপদে পড়বে। বিপদগুলো হলো-
১. তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে এবং তার কাজে কখনও স্থিরতা আসবে না।
২. যা সে দেখলো, তা অর্জিত না হওয়ায় তার মনে সব সময় আফসোস থাকবে। না পাওয়ার বেদনা ও পাওয়ার সুতীব্র চাহিদা তাকে সবসময় দহন ও দগ্ধ করবে।
৩. অসংযত দৃষ্টির দ্বারা ইবাদতের স্বাদ চলে যায়। ঈমান আর একিনের উপলব্ধি শুধু ওই ব্যক্তিরা অনুভব করতে পারে, যে তার দৃষ্টিকে সংযত করে।
৪. অসংযত দৃষ্টির দ্বারা অন্যের ইজ্জত, আব্রু, হারাম ও অশ্লীল বস্তুর দিকে নজর চলে যাওয়ায় নিজের ও অপরের অনেক বড় বিপদের কারণ সৃষ্টি হয়, যা থেকে উভয়েই জান-মালের বড় রকমের ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়।
ফলে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও সব সময়ই এবং বিশেষত রোজার সময়ে দৃষ্টিকে অবশ্যই সংযত রেখে ও চোখের হেফাজত করে রোজাকে পরিপূর্ণ করা দরকার। চোখের রোজা হলো চোখকেও সংযমের অধীনস্থ করা। চোখকে হেফাজত করা গেলে পাঁচটি উপকার পাওয়া সম্ভব। এগুলো হলো-
১. দৃষ্টি সংযত রাখার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার আদেশের আনুগত্য হয়।
২. মন পরিষ্কার ও প্রশান্ত থাকে।
৩. ফিতনা, ফাসাদ, বিপদ, অপরাধ, ক্ষতি ও পাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
৪. আত্মউপলব্ধি ও জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়ে অন্তর্দৃষ্টি প্রশস্ত হয়।
৫. পরিচ্ছন্ন মনে নূর বা আলো সঞ্চারিত হয়।
মাহে রমজানের সময় আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রোজা পালনের সময়কালে চোখকে পরিপূর্ণভাবে হেফাজত করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে রাখা প্রয়োজন। রোজায় খাদ্য, পানীয় ও কামের নিবৃত্তির দ্বারা শরীরকে যেমন কৃচ্ছ্বতার মাধ্যমে হেফাজত করা সম্ভব হয়, তেমনি চোখের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ ও হেফাজত করে অন্তরে স্থিরতা ও লজ্জাস্থানের পবিত্রতা বজায় রাখা সম্ভব হয়, যা রোজা ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য প্রতিপালন করা অপরিহার্য দায়িত্ব।
রোজার অন্যতম দিক হলো- আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতায়ালার আদেশের অনুসরণ করে শরীরবৃত্তীয় ক্ষুধা, কাম, রিপুকে সংযত রাখা এবং চোখ, মন, লজ্জাস্থানকে হেফাজত ও পবিত্র রাখা। কুদৃষ্টি ও মনের কুভাব, অপবিত্রতা ও সীমালঙ্ঘনকে দমন করাও প্রকৃত রোজার কর্তব্য, যা রোজার পরও একজন প্রকৃত মুসলমানকে মানসিকভাবে সুস্থির ও শারীরিকভাবে পবিত্র জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে।