বুধবার (২২ আগস্ট) বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশসমূহে সর্বোচ্চ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, যথাযোগ্য মর্যাদা, বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। ঈদের দিন সামর্থ্যবান মুসলমানরা বিনম্র হৃদয়ে ঈদুল আজহার দুই রাকাত নামাজ আদায় করবেন এবং নামাজ শেষে মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করবেন।
সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগই হলো- কোরবানি। কোরবানি শুধু একটি আনন্দ-উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। বাংলাদেশেসহ বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী আজকের ঈদুল আজহা দিনে পশু কোরবানির মাধ্যমে সত্যিকারের ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হবে। কারণ, কোরবানির ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে আনুগত্য পরীক্ষার মাধ্যমে।
তাই কোরবানি পালনের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা জানিয়ে দেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কারণে ঈদুল আজহা ও কোরবানি নিছক জাগতিক উৎসব নয়, আধ্যাত্মিকভাবে ত্যাগ স্বীকারের তাৎপর্যমণ্ডিত। এর মধ্য দিয়ে ভোগের জীবন থেকে সরে এসে ত্যাগ ও উৎসর্গের আদর্শ আত্মস্থ করার শিক্ষা মেলে।
আল্লাহতায়ালার জন্য নিজের জান-মাল ও প্রিয়তম জিনিস সন্তুষ্টচিত্তে বিলিয়ে দেওয়ার এক সুমহান শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর ঈদুল আজহা আমাদের মাঝে ফিরে আসে। ইসলামি বিধানমতে কোরবানি করা ওয়াজিব। কোরআনে কারিমের সূরা আল কাউসারে বলা হয়েছে, ‘অতএব তোমার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো।’ আর সূরা হজে বলা হয়েছে, ‘কোরবানি করার পশু মানুষের জন্য কল্যাণের নির্দেশনা।’
কোরবানির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। কোরবানি মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নত। কোরআনে কারিমে কোরবানির এই মহিমান্বিত ত্যাগের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে বিশদভাবে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর অনুপম ত্যাগের অনুসরণে হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বের মুসলমানরা কোরবানি করে আসছেন। কোরবানি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, কোরবানির পূর্বশর্ত আল্লাহভীতি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজের অনেকের মাঝে কোরবানির সময় ত্যাগের চেয়ে ভোগ প্রবল হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গরিব-দুঃখীরাও বঞ্চিত হয়। অনেক সময় দায়িত্বশীলতার ঘাটতিও দেখা যায়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ, হাদিস বলা হয়েছে, ‘মানুষের আমলের প্রতিফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ সূরা হজে বলা হয়েছে, ‘এগুলোর (কোরবানির) গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে যায়।’ কোরবানিদাতারা বিষয়গুলো জেনে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে আমাদের কোরবানি তবে স্বার্থক।
ইতোমধ্যে ঈদুল আজহার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
ঈদ উপলক্ষে মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আর শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এ নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীরা এবার ঈদের ছুটি পাচ্ছেন এক টানা ৫ দিন। নগরীর লাখ লাখ বাসিন্দা গ্রামের বাড়িতে আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করতে ইতোমধ্যে রাজধানী ছেড়ে গিয়েছেন। রেলওয়ে স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল ও বাস টার্মিনালগুলোতে এ কারণে এ কয়দিন ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বাস, ট্রেন ও লঞ্চে আসন না পেয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে এসব বাহনের ছাদে উঠে গন্তব্যে পৌঁছেছেন।
পবিত্র এ দিনটিতে উৎসবের আমেজ দিতে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সড়ক দ্বীপসমূহে জাতীয় ও ঈদ মোবারক খচিত পতাকা দিয়ে সুশোভিত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সকল সরকারি-বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা ও ঈদ মোবারক খচিত পতাকা উত্তোলন করা হবে। এছাড়াও নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের সকল কারাগার, সরকারি হাসপাতাল, ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম, শিশু সদন, ছোটমনি নিবাস, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র, সেফ হোম, দুস্থ কল্যাণ কেন্দ্র এবং শিশু ও মাতৃসদনে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহে সরকারি কর্মসূচির আলোকে ঈদুল আজহা উদযাপনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আজ এমন এক সময়ে ঈদুল আজহা উদযাপিত হতে যাচ্ছে, যখন সমাজ ক্রমেই অস্থিরতা ও নিষ্ঠুরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। পারস্পরিক সহমর্মিতার পথ থেকে মানুষ যোজন যোজন দূরে চলে যাচ্ছে। কোরবানির শিক্ষা মনে ধারণ করে, এই সংঘাত-সংঘর্ষের মনোবৃত্তি থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে। মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্ব তৈরি করতে হবে। সব ক্ষেত্রে ত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সেবার মানসিকতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে দুস্থ ও আর্ত মানুষের পাশে।