আরবি ভাষায় সূর্যগ্রহণকে ‘কুসুফ’ বলা হয়। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ‘কিসাফান’ ও ‘কিসফান’ শব্দ দিয়ে ‘ইনকিসাফুস শামস’ অর্থাৎ সূর্যের অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। যাকে আমরা সূর্যগ্রহণ বলে জানি।
রোববার (২১ জুন) বাংলাদেশ থেকে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে।
সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণকে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে এতদুয়ের ওপর একটি ক্রান্তিকাল হিসেবে গণ্য করা হয়। সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। এর প্রমাণস্বরূপ আল্লাহতায়ালা এ দু’টোর ওপর ‘গ্রহণ’ দান করেন। আর এই দু’টি আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শন বৈ অন্য কিছু নয়।
ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সতর্কবাণী পৌঁছে দেয় যে, অন্যান্য সৃষ্টির মতো চন্দ্র-সূর্যও আল্লাহর সৃষ্টি; এরা উপাসনার যোগ্য নয়। চন্দ্র-সূর্যইতো বিপদাক্রান্ত হয়, তাই এগুলো উপাস্য হতে পারে না। বরং এ দু’টিকে আল্লাহতায়ালাকে চেনার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাই হলো- বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, আর চন্দ্রকেও না; আল্লাহকে সিজদা করো, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা নিষ্ঠার সঙ্গে শুধু তারই ইবাদত করে থাকো।’ -সূরা হা-মিম সিজদা: ৩৭
অন্ধকার যুগে মানুষের ধারণা ছিল, কোনো মহাপুরুষের জন্ম-মৃত্যু বা দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির বার্তা দিতে সূর্য বা চন্দ্রগহণ হয়। ইসলাম এটাকে একটি ভ্রান্ত ধারণা আখ্যায়িত করেছে। গ্রহণকে সূর্য ও চন্দ্রের ওপর একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল বা বিপদের সময় গণ্য করেছে।
এ কারণে সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের সময় মুমিনদের অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা যেন এ সময়ে আল্লাহর তাসবিহ ও পবিত্রতা বর্ণনা করে। দোয়া, নামাজ ও আমল ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকে।
হাদিসের সূর্যগ্রহণ প্রসঙ্গে অনেক বর্ণনা রয়েছে। এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বলেন, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনটিতেই সূর্যগ্রহণ হয়। তখন আমরা সবাই বলাবলি করছিলাম যে, নবী করিম (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুর কারণেই এমনটা ঘটেছে। আমাদের কথাবার্তা শুনে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে দু’টি নিদর্শন, কারও মৃত্যু বা জন্মের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না।’ –সহিহ বোখারি: ১০৪৩
আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ছিলাম। এমন সময় সূর্যগ্রহণ শুরু হয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের চাদর টানতে টানতে মসজিদে প্রবেশ করেন। আমরাও প্রবেশ করি। তিনি আমাদের নিয়ে সূর্য প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি বলেন, কারও মৃত্যুর কারণে কখনও সূর্যগ্রহণ কিংবা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তোমরা যখন সূর্যগ্রহণ দেখবে তখন এ অবস্থা কেটে যাওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করবে এবং দোয়া করতে থাকবে।’ –সহিহ বোখারি: ৯৮৩
হজরত আবু মুসা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর যুগে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। তখন তিনি এই আশঙ্কায় উঠে দাঁড়ালেন যে, কিয়ামতের মহাপ্রলয় বুঝি সংঘটিত হবে। তিনি দ্রুত মসজিদে চলে আসেন। এরপর অত্যন্ত দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু ও দীর্ঘ সিজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। আমি আর কোনো নামাজে কখনও এমন (দীর্ঘ) দেখিনি। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর এসব নিদর্শনাবলি কারও মৃত্যুর কারণে হয় না, কারও জন্মের কারণেও হয় না। তিনি এগুলো প্রেরণ করেন তার বান্দাদের সতর্ক করার জন্য। যখন তোমরা এসব নিদর্শনাবলির কিছু দেখতে পাও তখন তোমরা আতঙ্কিত হৃদয়ে আল্লাহর জিকির-স্মরণ, দোয়া ও ইস্তিগফারে ব্যস্ত হও। -সহিহ মুসলিম: ১৯৮৯
অধিকাংশ সময়ই আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত আনন্দ আর কৌতুহল নিয়ে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ প্রত্যক্ষ করে থাকেন। অথচ বিষয়টি মোটেও আনন্দের নয়, ভয় ও ক্ষমা প্রার্থনার মুহূর্ত।
সূর্য ও চন্দ্র যখন গ্রহণের সময় হয় নবী করিম (সা.)-এর চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেতো। তখন তিনি সাহাবিদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন। কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। আমাদেরও উচিৎ এই সময়টাকে উৎসবের মুহূর্ত না বানিয়ে আল্লাহর স্মরণে ও তার সাহায্য কামনায় ‘কুসুফের নামাজ’ আদায় করা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতে এটা আরও বেশি দরকার।
সূর্যগ্রহণের সুন্নত আমল হিসেবে কুসুফের নামাজ আদায় করা হবে মসজিদের নববী ও মসজিদের হারামে। স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে মসজিদে হারামে সূর্যগ্রহণের নামাজ পড়াবেন শায়খ ড. ফয়সাল গাজ্জাবি।