পানি জীবনের চালিকাশক্তি। বলা হয়, পানির অপর নাম জীবন। আল্লাহতায়ালা সমস্ত সৃষ্টির জন্য পানিকে কাজে লাগিয়েছেন। আর মানুষের জন্য পানি মৌলিক উপকরণ। একটা মানুষের শরীরের এক তৃতীয়াংশই হলো পানি। দৈনিক একজন সুস্থ মানুষের দুই লিটারের বেশি পানি পান করার দরকার হয়। শরীরে পানির পরিমাণ কমে গেলে শরীরের সতেজতা থাকে না। দিন দিন শরীর শুকিয়ে যায়।
পবিত্র কোরআনে ৫৯ স্থানে পানির আলোচনা এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে আকাশ থেকে বর্ষিত পানি। জমিন থেকে উদগত পানি ও জমিনে রক্ষিত পানি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখো না যে, আল্লাহ আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর এটা ভূমিতে নির্ঝররূপে প্রবাহিত করেন এবং এর দ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন।’ -সূরা যুমার: ২১
পানি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না। পশু-পাখি, জীবজন্তু জীবণধারণ করতে পারবে না। ফল-ফসল উদগত হবে না। পানির প্রয়োজনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। পানি মানুষ পান করে। চারণভূমি সতেজতা লাভ করে। সবুজ-শ্যামল হয়। এর দ্বারা জমিন অপরূপ সুন্দর রূপ ধারণ করে। দর্শকের জন্য সেই দৃশ্য কত না সুন্দর মনোরম! মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্যে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। এই পানি থেকে তোমরা পান করো এবং এ থেকেই উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়, যাতে তোমরা পশু চারণ করো। এ পানি দ্বারা তোমাদের জন্যে উৎপাদন করেন ফসল, যয়তুন, খেজুর, আঙুর ও সর্বপ্রকার ফল। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। -সূরা নাহল: ১০-১১
হাদিসে বর্ণিত আছে, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘তিনটি নিয়ামত এমন রয়েছে, যা সর্বসাধারণের জন্য ব্যাপক করে দেওয়া হয়েছে। তা হচ্ছে- পানি, ঘাস ও বাতাস।’ -সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৭৭
পানি পান করানোর ফজিলত
পানি পান করানোর অনেক ফজিলত রয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান কোনো বস্ত্রহীনকে বস্ত্র পধিান করাবে, আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরিধান করাবেন। যে ব্যক্তি কোনো ক্ষুধার্ত মুসলমানকে খাবার দেবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো পিপাসার্ত মুসলমানকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাকে উৎকৃষ্ট জান্নাতের শরাব পান করাবেন, যার ওপর সীল লাগানো থাকবে।’ -সুনানে আবু দাউদ
মহানবী (সা.) বলেন, ‘কাউকে দান করার উত্তমপন্থা হলো তাকে পানি দান করা।’ হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমার বন্ধুকে হাসিমুখে বরণ করা সদকা, কাউকে তার প্রাণীর ওপর মালামাল তুলে দেওয়া সদকা এবং প্রতিবেশীর পাত্রে পানি তুলে দেওয়াও সদকা।’ -সুনানে তিরমিজি
সহিহ বোখারিতে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তায় চলার পথে অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হলো। তারপর একটি কূপ দেখতে পেয়ে তাতে সে নেমে পড়ল এবং পানি পান করল। ওপরে উঠে এসে সে দেখতে পেলো, একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে আর পিপাসার দরুন ভিজা মাটি চেটে খাচ্ছে। লোকটি (মনে মনে) বলল, এ কুকুরটির তেমন পিপাসা পেয়েছে, যেমনি আমার পিপাসা পেয়েছিল। তারপর সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা পানি ভর্তি করে এনে কুকুরটিকে পান করাল। আল্লাহ তার এ কাজ কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। সাহাবিগণ বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পশুদের ব্যাপারেও কি আমাদের জন্য সওয়াব রয়েছে? তিনি বললেন, প্রাণী মাত্রের সেবার মধ্যেই সওয়াব রয়েছে।’ -সহিহ বোখারি: ২৪৬৬
পানি মানুষের জন্য সহজলভ্য করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ
পানি মানুষের বেশি দরকার পড়ে। এ জন্য পানি নিয়ামতটি অতি সহজে মিলে। মরুভূমি ও মাটি থেকে বের হয় পানি। সৃষ্টিজীব যদি আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতা করে, তখন তাদেরকে পানি থেকে বঞ্চিত করে দেন তিনি। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছো কি, যদি পানি ভূগর্ভে তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন কে তোমাদের এনে দেবে প্রবহমান পানি?’ -সূরা মূলক: ৩০
আসমানের পানি বন্ধ হওয়ার কারণ জাকাত না দেওয়া
আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো, ধন-সম্পদের সঠিকভাবে জাকাত না দেওয়া। সাহাবি হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার মহানবী (সা.) আমাদের কাছে আসলেন। অতঃপর বললেন, যারা নিজের ধন-সম্পদের জাকাত বন্ধ করে দেবে, তাদের জন্য আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ রাখা হবে। এমনকি চতুষ্পদ জন্তু না থাকলে আদৌ বৃষ্টি হবে না।’ -হিলইয়াতুল আওলিয়া: ৩/৩২০, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪০১৯
পানি থেকে নিষেধ করা অমানবিক
পানি এমন জিনিস যা থেকে মানুষকে নিষেধ করা খুবই অমানবিক। হাদিস শরিফে এসেছে, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) প্রিয়তম রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এমন কোনো বস্তু রয়েছে, যা থেকে মানুষকে নিষেধ করা যায় না? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, পানি।’ -সহিহ বোখারি: ৩৪৭৭
আবদ্ধ পানিতে প্রস্রাব-পায়খানা না করা
পানি অতি মূল্যবান। এ জন্য এটাকে নষ্ট করা গোনাহের কাজ। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা স্থির পানিতে পেশাব করো না, নাপাকি ফেলো না। কেননা তা তোমরা ব্যবহার করবে।’ -সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৭৮
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষের কষ্ট হয়, এমন তিনটি কাজ পরিহার করো। পানির উৎস, চলাচলের রাস্তা ও গাছের ছায়ায় মলত্যাগ করো না।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ
পানি অপচয় না করা
অপচয় করা শয়তানের কাজ। এ জন্য অজু-গোসলেও পানি যত কম ব্যবহার করা যায় ততই ভালো। নবী করিম (সা.) খুব অল্প পানি দিয়ে অজু-গোসল সারতেন। সাহাবি হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) এক সা (৪ মুদ) থেকে পাঁচ মুদ পর্যন্ত পানি দিয়ে গোসল করতেন এবং অজু করতেন এক মুদ (প্রায় ১ লিটার বা ৭৯৬ মিলি সমপরিমাণ) দিয়ে।’ -সহিহ বোখারি: ২০১
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এক সময় সাদ (রা.)-এর কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। হজরত সাদ (রা.) তখন অজু করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, পানি অপচয় করছো কেন? সাদ (রা.) উত্তর দিলেন, অজুতেও পানি অপচয় হয়? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, প্রবহমান নদীতেও যদি তুমি অজু কর তবুও অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা যাবে না।’ -মুসনাদে আহমদ
মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ