বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের যুগ থেকেই স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখে মুসলমানগণ রোজা ও ঈদ পালন করে আসছেন।
চাঁদ দেখার পর ১০ দিন সময় থাকলেও ঈদুল আজহার চাঁদ খেলাফতের অধীন কোনো অঞ্চলে বা মদিনার বাইরে কোনো প্রদেশে দেখা গিয়েছে কিনা এ সংবাদ নেওয়ার চেষ্টার কথা কোনো হাদিস বা ইতিহাসে নেই।
বরং তাবেয়ি হজরত কোরাইবের বর্ণনা এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, উদয়স্থলের ভিন্নতার কারণে এক শাসনের অধীনে হওয়া সত্যেও সে যুগের মুসলিম উম্মাহ একদিনে ঈদ ও রোজা করেননি।
সিরিয়ায় হজরত মুয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক রমজানের চাঁদ দেখার এবং শনিবার রোজা শুরু করার খবর ঈদের তিনদিন আগে পেয়েও ওই সাহাবি বলেছেন, আমরা মদিনার আকাশে শাওয়ালের চাঁদ দেখব, অথবা ৩০ দিনে মাস পূর্ণ করে ঈদুল ফিতর পালন করব।
এই ধারা ও রীতিই স্থায়ী, প্রাকৃতিক এবং ইবাদতের মূল দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।
তাছাড়া ঈদ একটি জাতীয় ইবাদত উৎসব ও বিষয়। ইসলামি আইনেই উলামা ও ফকিহগণের (ইসলামি স্কলার) সহযোগিতায় এর সিদ্ধান্ত ঘোষণার অধিকার সরকারের। তাই সরকারের শরিয়াসম্মত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা একটি ফেতনা। সুতরাং বাংলাদেশের কিছু গ্রামের একদিন আগে ঈদ পালন একটি বেআইনি কাজ ও ফেতনা।
বর্তমান মিডিয়ার কারণে কারো কারো কাছে মনে হয়, ঈদে মুসলিম উম্মাহ ভিন্ন! বড় দিনের মতো একসঙ্গে হয় না কেন? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নের এ যুগে ঐক্য না করে আলেম সমাজ দায়িত্বহীনতা বা গোঁড়ামির পরিচয় দিচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, রোজা ও ঈদ পালনে সারাবিশ্ব এক হওয়া জরুরি নয়। আরও জবাব হচ্ছে, সূর্যের গতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় নামাজের সময়ে বিশ্বব্যাপী যেমন পার্থক্য স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। তেমনি চাঁদের গতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে রোজা শুরু ও ঈদ পালনে বিশ্বজুড়ে আগপিছ হওয়াও স্বাভাবিক। আর রোজা ও ঈদের ক্ষেত্রে একদিন দু’দিনের ব্যবধানের কারণ হলো, সূর্যের মতো নতুন চাঁদ উদয়স্থলে বেশি সময় দৃশ্যমান থাকে না। দূর পশ্চিমে দেখার পর পূর্বের দেশে খবরটি পৌঁছাতে কোথাও তারাবির সময় কোথাও সাহরির সময় পার হয়ে যায়। অথবা এত অল্প সময় থাকে যে, দেশের সব মুসলিমের আমল করা কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন জাপান ও নিউজিল্যান্ড।
অথচ ইসলামের মৌলিক নীতি হচ্ছে, ‘আল্লাহতায়ালা মানুষের সাধ্যের বাইরে কোনো বিধান চাপিয়ে দেন না।’ -সূরা বাকারা: ২৮৬
আরেকটি কথা ভাবতে হবে, মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ ‘চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে ঈদ করো’র তামিল কোনো দু’জন বিশ্বস্ত মুসলিম করার পর সারাবিশ্বকে জানানো বিশ বাইশ বছর আগে কি সম্ভব ছিল? এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে বলেই কি একথা বলা যাবে যে, দেড় হাজার বছর ধরে প্রযুক্তির অভাবে মুসলিম উম্মাহ ভুল করে আসছে? ঈদের দিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ সত্যেও আমাদের মুরব্বিরা রোজা রেখেছে? শবে কদর কয়দিন? আরাফার রোজা কবে? ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে সংস্কারবাদীরা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন।
আল্লাহ না করুন, করোনাভাইরাস যেমন বৈশ্বিক সবকিছুর চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এমন কোনো যুদ্ধ বা বিপত্তি যদি কল্পনাতীতভাবে বিশ্বে ঘটে আর তথ্য আদান-প্রদান ও যোগাযোগ সাময়িকভাবে হলেও অকার্যকর হয়ে যায়, অথবা কেয়ামতের প্রাক্কালে আইটি ধ্বংস হয়। তখন কি সবাইকে আবার প্রাচীন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে না?
সমস্যা হলো, ‘প্রথম দেখা’র সংবাদে আমল করার ব্যাপারে। ঈদ পালন ও রোজার বিষয়ে বর্তমানে যারা অন্ধের মতো সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আমল করে চলছেন, তারা মূলত শরিয়তে নেই। অথবা তাদের দেশে গভীর জ্ঞানী কোনো আলেম বা ফকিহ নেই। যেমন মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুর। কিংবা শক্তিমান মুসলিম শাসনের অধীনে নেই। যে কারণে তারা মনে করেন, এত দায় দায়িত্ব ও ঝামেলা করার দরকার নেই, সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আমল করতে থাকি।
সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ করার কোরো শরয়ি ভিত্তি নেই। হাদিসে প্রথম দেখার মর্মকথা আছে। আর প্রথম নতুন চাঁদ পশ্চিমা কোনো দেশের আকাশে দৃশ্যমান হয় বেশি। সৌদি আরব বা হেজাযের কথা হাদিস-ফিকহ কোথায়ও নেই। বরং বিজিত হওয়ার পর থেকেই পবিত্র মক্কা ও মদিনার ব্যতিক্রমে রোজা ও ঈদ পালন করার হাজার বছর ধরে নজির আছে মিসর, সিরিয়া, কুফা, বসরা ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর।
ওআইসি ফিকহ একাডেমির সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়। ওআইসি ফিকহ একাডেমির সিদ্ধান্তের ভলিয়ম আমার কাছে আছে। জেদ্দা থেকে নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে বিভিন্ন বছর বিভিন্ন সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ লিপিবদ্ধ আছে। উদয়স্থলের ভিন্নতা মেনে চলার স্বীকৃতিও আছে। আবার এক শহরে চাঁদ দেখা ‘সাব্যস্ত হলে’ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিমদের জন্য তা প্রযোজ্য এ রকম সিদ্ধান্তও আছে। কিন্তু বিশ্বের জমহুর উলামা ও ফকিহগণ এ বিষয়ে কখনও একমত না হওয়ায় সবদেশের সরকার একমত হতে পারেনি।
রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক চরিত্র বিবেচনায় কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে বাস্তবেও এমন কোনো দেশ কি আছে? যে দেশের চাঁদ দেখার খবর ও ঘোষণা অন্য সবদেশ অন্ধভাবে বিশ্বাস করে নিজ দেশের মানুষকে বছরের পর বছর রোজা, তারাবি, ঈদ ও কোরবানি করার জন্য বলবে?
সর্বোপরি ইসলামি ইবাদত-বন্দেগির বৈশিষ্ট্য হলো, সারাবিশ্বে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হতে থাকবে। কোথাও আজান, কোথাও নামাজ। কোথাও ফজর, কোথাও জোহর। কোথাও রোজা, কোথাও ইফতার, কোথাও ঈদ আর কোথাও কোরবানি। বিশ্বময় মুসলিম উম্মাহ আল্লাহতায়ালার মহিমা ঘোষণা করতে থাকবে। তাওহিদের বাণী উচ্চারিত হতে থাকবে সর্বত্র, সবসময়।
তর্কের খাতিরে যদি সংস্কারবাদীদের কথা সমর্থন করা হয়, তাতেও অনেক সমস্যা রয়েছে। যেমন, পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বের সব দেশের সরকার ও ফকিহগণ একমত না হওয়া পর্যন্ত প্রযুক্তিনির্ভর এই নতুনধারা সারাবিশ্বে চালু করা ঝুকিপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালনে মধ্যপ্রাচ্যের মতো শাসকদের ঘোষণায় পুরো মুসলিম উম্মাহর নির্ভর করা কতটুকু নিরাপদ হবে?
শায়খ বিন বায, শায়খ সালেহ আল উছাইমিন ও শায়খ তকি উসমানিসহ আরব আজমের ফকিহগণ এ বিষয়ে একমত যে, ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকে চলে আসা রীতি সম্পূর্ণ সঠিক। দ্বিতীয় মতটি কিতাবে থাকলেও কোনোদিনই বাস্তবে আসেনি।
বিজ্ঞ আলেমদের মতে, এ দেশে যারা এক উদয়স্থলে এবং এক সরকারের অধীনে থেকে ভিন্ন দিনে রোজা ও ঈদ পালন করছেন, তারা একাধারে শরিয়ত ও সরকার বিরোধী কাজ করছেন। তারা না সৌদি আরবের সঙ্গে আছেন, না প্রথম দেখার সঙ্গে। তাদের ঈদ কখনও সৌদির সঙ্গে মেলে আবার কখনও প্রথম দেখার সঙ্গে।
আর একটি ধারণা এখন বেশি প্রচার হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে রোজা ও ঈদ পালনে লুনার ক্যালেন্ডার অনুসরণ। বিজ্ঞ মুহাদ্দিসদের মতে, এটি বাস্তবায়নের দাবিদাররা শরিয়তের সীমারেখার বাইরে চিন্তা করছেন। কারণ, নামাজের ওয়াক্তের জন্য সূর্যের বিকল্প ঘড়ি হয়। কিন্তু রোজা শুরু ও ঈদ পালনে চোখে চাঁদ দেখার কোনো বিকল্প নেই। কেননা, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজের সময়সূচি কথায় ও আমলের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর রোজা শুরু ও ঈদ পালনের ক্ষেত্রে বলেছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে ঈদ করো। যদি আকাশ অস্পষ্ট থাকে তাহলে শাবান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করে নাও।’ -সহিহ বোখারি: ১৯০৯
সব মুহাদ্দিস এ বিষয়ে একমত যে, মহানবী (সা.) এ হাদিসে সরাসরি চাঁদ দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি একটি পর্যালোচনা। এর সঙ্গে সহমত ও দ্বিমত পোষণের অবকাশ আছে। এ বিষয়ে জ্ঞানী আলেমদের পরামর্শকে স্বাগত জানাই।
মুফতি ওয়ালীউর রহমান খান: মুহাদ্দিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ