দমদমে যশোহর রোডের উৎপত্তিস্থলে

, কলকাতা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 05:19:54

দমদম (কলকাতা) থেকে: ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ঐতিহাসিক কারণে প্রসিদ্ধ যশোহর রোড শুরু হয়েছে কলকাতা মহানগরের উত্তরাংশে অবস্থিত দমদম এলাকার একটি মাজারের পাদদেশ থেকে।

দমদম এয়ারপোর্ট ১ নং গেটের সামনের ত্রিমোহনী যশোহর রোডের উৎপত্তি। সেখানেই ১ নং যশোহর রোড অবস্থিত, যে ঠিকানার একটি প্রাচীন মাজারে শুয়ে আছেন একজন বুজুর্গ। পাশেই মসজিদ।

ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্ববহ যশোহর রোডের উৎপত্তিস্থলটি দেখতে হলে শুরু করতে হবে দমদম থেকে। দমদমের নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১নং গেট মোড়ে দেখা গেলো ১নং যশোহর রোড ঠিকানা লেখা জায়গাটি। তাতে রয়েছে হযরত দাতা সুলতান শাহ (রহ.)- এর মাজার শরিফ ও মসজিদ।

রাস্তার একেবারে উপরেই মাজারটি অবস্থিত। দীনহীন তার কাঠামো ও অবয়ব। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। ভক্তদের সমাবেশ আর নারী-পুরুষের ভিড়। হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই আছেন দর্শনার্থী তালিকায়। হাতে ফুল, মোম, আগরবাতি। পুরো চৌহদ্দী আতর, লোবানের গন্ধে মাতোয়ারা।

মসজিদ, মাজারের কাঠামো খুবই প্রাচীন। ব্রিটিশ আমলের তো হবেই। এর আগেরও হতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আকারে লিপিবদ্ধ নেই কিছুই। মাজারে শায়িত সাধকের সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যায় নি।

মসজিদ, মাজার, ফুলের দোকান, ছবি: বার্তা২৪.কম

মোবারক হোসেন নামের একজন স্থায়ী বাসিন্দার দেখা পেলাম। তিনি মাজার ঘেঁষে চলে যাওয়া পাশের পি. কে গুহ রোডে থাকেন। বললেন, 'জন্ম থেকে মসজিদ-মাজার দেখছি। বাপ-দাদার কাছ থেকেও শুনেছি। আল্লাহর কাছে বহুজন বহু দোয়ার আর্জি নিয়ে এখানে আসেন।'

দেখা গেলো মসজিদ, মাজারের দেওয়ালে ও লোহার গরাদে ঝুলছে সুতা, হাতে লেখা দরখাস্ত। মানুষ মনোবাঞ্ছার কথা নানাভাবে দাখিল করছেন আল্লাহতায়ালার কাছে। 'শুধু সাধারণ মানুষই নন, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজন এখানে আসেন।' বললেন মোবারক সাহেব।

মসজিদ ও মাজারের সামনে কয়েকটি ফুলের দোকানে নানা বর্ণ, রঙ ও গন্ধের পুষ্পাঞ্জলি সাজানো। পবিত্র প্রয়োজনে মানুষ নিয়ে যাচ্ছেন ফুল। কেউ মাজারের জিয়ারতে দিচ্ছেন ফুলেল শ্রদ্ধা। কেউ কেউ পূজাকর্ম সারছেন পুষ্পের সম্ভারে। কেউ হয়ত অন্তহীন প্রেমে ও ভালোবাসায় প্রেমিক-প্রেমিকা-প্রিয়জনের হাতে তুলে দিচ্ছেন ফুল।

দমদম এয়ারপোর্ট ফার্স্ট গেটে ১নং যশোহর রোডের মসজিদ, মাজার আর পুষ্পের মেলায় দু'দণ্ড অপেক্ষা করে মন ছুঁয়ে গেলো ভালো লাগায়। ভালোবাসা, প্রেম, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের একটি চিরায়ত বোধ অনুভবে টের পেলাম পুষ্প ও প্রার্থনার পবিত্র সম্মিলনে।

একদা যশোহর আর দমদমের এয়ারপোর্ট এবং বিমানবাহিনীর ঘাঁটি দুটির মধ্যে বিকল্প যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য ব্রিটিশ সরকার গুরুত্ব দিয়ে যশোহর রোড আধুনিকভাবে নির্মাণ করেছিল। যদিও এ সড়কটি সুলতানি ও মুঘল আমলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতো, তথাপি সড়কটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার স্বরূপ।

১নং যশোহর রোডের সামনে দাঁড়ালে চোখে মানবস্রোতের প্লাবন ভাসে। নানা জাতের, নানা প্রদেশের গাড়ি ও মানুষ অবিরাম বয়ে চলেছে। যশোহর রোড বারাসাত, বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, দিল্লির দিকে নানা জাতীয় সড়কের সঙ্গে মিশে বাংলা ও ভারতের সংযোগসূত্রের কাজ করছে।

মাজার শরিফ, ছবি: বার্তা২৪ কম

দমদম এয়ারপোর্ট গেট ওয়ান থেকে যশোহর রোড নাগের বাজার হয়ে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার দিয়ে মূল শহরে প্রবেশ করেছে। এটিই ছিল যশোহর ও কলকাতার আদি ও একমাত্র যোগাযোগ পথ। এখন অবশ্য ভিআইপি রোড হয়েছে। এয়ারপোর্ট গেট ওয়ান বা ১নং গেটের সামনে ১ নং যশোহর রোডের মোড় থেকে বের হয়েছে ভিআইপি রোড, যা কেষ্টপুর, উল্টোডাঙ্গা, কাকুরগাছি, মানিকতলা হয়ে কলকাতা সেন্ট্রালে চলে গেছে।

যোগাযোগ ও ইতিহাসের সুপ্রাচীন জনপথ যশোহর রোডের পাশে এসে দাঁড়ালে আবশ্যিকভাবে মনে পড়বে অতীতের খণ্ড খণ্ড চিত্র, বিভিন্ন ভূগোল আর শতবর্ষী গাছগুলোর কথা। চোখে ভাসবেই ১৯৭১ সাল। শত্রু কবলিত আক্রান্ত বাংলাদেশের রক্তাক্ত আর্তনাদ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দেশত্যাগের আদিঅন্তহীন নগ্ন পদধ্বনি।

মনে পড়বেই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে মানব বিপর্যয় নিয়ে রচিত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের অমর ও ঐতিহাসিক কবিতা 'সেপ্টেম্বর অন যশোহর রোড'-এর হৃদয়স্পর্শী লাইনগুলো:

'শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,
যশোহর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।'

 




এ সম্পর্কিত আরও খবর