কলকাতার নাভিমূল ধর্মতলায়

, কলকাতা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 05:19:29

ধর্মতলা (কলকাতা) থেকে: ঢাকার যেমন গুলিস্তান, কলকাতার তেমনি ধর্মতলা। টিপু সুলতান মসজিদের সামনে ধর্মতলা আর আশেপাশের চৌরঙ্গি, চাঁদনি, এসপ্লানেট নিয়ে জায়গাটুকু থেকেই হাতের রেখার মতো অসংখ্য সড়ক মহানগরের নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ধর্মতলা থেকেই এক পাশে নিউমার্কেট-তালতলা, পার্ক স্ট্রিট-মল্লিক বাগান আর অন্য পাশে বাবুঘাট, হাইকোর্ট, রাইটার্স, গঙ্গার তীর। বড়বাজার, বৌ বাজার, লালবাজারও আশেপাশেই। দক্ষিণ আর উত্তর কলকাতার রাস্তাগুলো এখান দিয়ে গেছে। লোকজন বাস বদল করে গন্তব্যে যেতে ধর্মতলা-চৌরঙ্গি-এসপ্লানেট এলাকার উপর নির্ভরশীল।

দিনমান লোক আর যান চলাচলে মুখরিত ধর্মতলা। সামনেই কার্জন পার্ক, রানি রাসমনি পার্ক, ট্রাম ডিপো। আরো সামনে এগিয়ে গেলে ময়দান বা ব্রিগেট, শহিদ মিনার।

ধর্মতলা ও আশপাশের এলাকাটি মুসলিম প্রধান। চৌরঙ্গির দিকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ঘরবাড়ি। এসব স্থায়ী লোকজন ছাড়াও বৃহত্তর কলকাতার বিভিন্ন এলাকার বিচিত্র ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের যাতায়াত ও কথাবার্তায় ধর্মতলায় কলকাতার সত্যিকারে মাল্টিকালচারাল ইমেজের দেখা পাওয়া যায়।

অফিস সময়ে এখানে খেই পাওয়া ভার। পাশে সেন্ট্রাল এভিনিউ শুরুর মাথায় 'স্টেটসম্যান' পত্রিকার জবুথুবু, প্রাচীন, অতিকায় অট্টালিকার কোণে দাঁড়িয়ে এক বর্ণিল কলকাতার দেখা পাওয়া গেলো। বাহরি পোষাকে নানা বয়সের শশব্যস্ত নারী-পুরুষ ছুটছেন।

ব্রিটিশ মালিকানার 'স্টেটসম্যান' পত্রিকা এখন আগরওয়ালাদের মালিকানায়। কলকাতায় এসে জানলাম স্টেটসম্যান বাংলায় বের হয়! 'আনন্দবাজার' এখন পড়তির দিকে। লোকজনের কাছে নাম শোনা গেলো 'বর্তমান'-এর। 'আজকাল', 'গণশক্তি' চলছে মোটামুটি। কলকাতার পত্রিকাগুলো নানা দল ও মতবাদের অনুসারী হওয়ায় নির্দিষ্ট পাঠক নির্দিষ্ট পত্রিকাকে পছন্দ করেন।

সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে থাকলো কলকাতার নাভিমূলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো। টিপু সুলতান মসজিদে এশার আজাদ হতেই পাশের অফিস পাড়া শুনশান। বেসরকারি অফিসের কেরানি, পিএ, রিসেপশনিস্টরা বের হলেন তখন। সব কিছু গোছগাছ করে তারা ফিরছেন সবার শেষে। তখন ধর্মতলা, চৌরঙ্গির আরেক রূপ। সবাই বাড়ি ফেরার পথে সামান্য ফল, সবজি বা প্রয়োজনীয় বাজার সেরে নিচ্ছেন।

টিপু সুলতান মসজিদের সামনের অংশটি ঘিরে রাস্তাগুলো। মসজিদের পেছনের দিকে প্রবেশ পথ, জায়গাটির নাম ধর্মতলা স্কোয়ার। সেন্ট্রাল এভিনিউ আর চৌরঙ্গিকে মিলিত করেছে ধর্মতলা স্কোয়ারের গলিপথ। ক্লান্ত হয়ে সেখানকার এক হোটেলে ফালুদা খেতে খেতে দেখতে পেলাম দিনশেষে ঘুমের আয়োজনে যাওয়ার পথে নগর ও নগরের অধিবাসীদের।

ঘরে ফেরার জন্য আমিও বেরিয়ে এসে চমকে গেলাম। ডিজিটাল যুগের দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক বৃদ্ধ তিন সাগরেদকে নিয়ে দিব্যি ঘড়ির দোকান চালাচ্ছেন। বিক্রি আর মেরামত দুটিই চলছে সেখানে।

'আগের মতো ঘড়ির চাহিদা আছে?' আমার প্রশ্নে বৃদ্ধ দোকানি মুখ তুলে তাকালেন, 'তা নেই! তবে ঘড়ি এখনো বিলীন হয় নি', মৃদু হাসলেন তিনি।

উর্দু-ঘেঁষা বাংলায় কথা বলা ঘড়ির কারবারি ভদ্রলোকের নাম ওসমান মিয়া। দক্ষিণের বন্দর-ডক এলাকা খিদিরপুর থেকে দোকান করতে আসেন তিনি। কর্মচারিরাও থাকেন দক্ষিণের মুসলিম এলাকা আলিপুর, মেটিয়াবুরুজে।

কল্লোলিনী কলকাতায় এই বিশ্বায়নের তাণ্ডব গতির যুগেও এক প্রবীণ বৃদ্ধ সময়ের প্রতীক ঘড়ির ব্যবসায় মনপ্রাণ দিয়ে লেগে আছেন। কলকাতা ও দক্ষিণ এশিয়ার বহু পালাবদল, শান্তি, সংঘাত, দাঙ্গা, হাঙ্গামার পালাবদলেও তিনি যেন দেখছেন বয়ে যাওয়া সময়ের বহুমাত্রিক স্রোত।

বাড়ি ফেরার সময় নিঝুম যাত্রাপথে আমার তখন বার বার মনে পড়ছিল লালনের কথাগুলো: 'সময় গেলে সাধন হবে না...।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর