নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ও কলকাতা

, কলকাতা

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:50:29

কলকাতা থেকে ফিরে: ঔপনিবেশিকতার জঠরে জন্ম নেওয়া শহর কলকাতার ইতিহাসে হাত ধরাধরি করে চলে আলো ও অন্ধকার। একদিকে বাবুবৃত্তান্ত, বাঈজি নাচ, বিলাশ ও অপচয়ের ইতিবৃত্ত আর অন্যদিকে সৃজনের ইতিহাস কলকাতার পরস্পরবিরোধী সত্ত্বার প্রতিচ্ছবি।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র সড়কের এন্টালি পয়েন্টে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো মনে পড়লো।

লাল রঙের বাড়িটিতে বেগম রোকেয়ার একটি মাত্র স্মারক ছাড়া আর কিছুই নেই। কোনো এক কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে অফিস বানিয়েছে। মধ্য কলকাতার প্রায়-পুরোটা জুড়েই এ রকম বহু ঐতিহাসিক বাড়ি ‘এনিমি প্রোপার্টি’ হয়ে নানা প্রভাবশালী মহলের ভোগ-দখলে চলে গেছে। পার্ক সার্কাসের সোহরাওয়ার্দি পরিবারের বহু সম্পত্তি নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে। পাশেই ২৯ গড়িয়াহাট রোডে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাড়ি, গোলপার্কের পেছনে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড়ে ইস্পাহানিদের বাড়ি এখন কাদের দখলে কেউ জানে না। একটি বাড়ির প্রাচীরে ‘মসজিদের জন্য ওয়াকফ’ সম্পত্তি সাইনবোর্ড লাগানো দেখেছি। কিন্তু সেখানে উঠেছে সুরম্য বহুতল ফ্ল্যাট। দেশভাগের সময় কলকাতার সবচেয়ে দামি এই এলাকা থেকে চলে যাওয়া মানুষদের সেইসব বাড়ির বাসিন্দা এখন অন্যলোক।

নিবু নিবু সন্ধ্যায় রোকেয়ার বাড়িটির সামনে যখন পৌঁছাই, তখন রাতের কলকাতার প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার চারদিক ঘিরে এসেছে। সামনেই আরেক আলোকময়ী মাদার তেরেসার বাড়ি। সেখান থেকে কিছুটা এড়িয়ে মোড় নিলে আলীমুদ্দীন স্ট্রিটে ‘ ‍মুজফফর ভবন’-এ কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। এলাকাটি উর্দুভাষী অতি দরিদ্র মুসলিম জনবসতিতে পূর্ণ। রাস্তার ভাঙা কল থেকে পাণীয় জল সংগ্রহরত এক মুসলিম বালিকাকে দেখে পশ্চিমবঙ্গে সুদীর্ঘ কমিউনিস্ট শাসনের অনুন্নয়ন চিত্রটিকে অস্বীকার করা সম্ভব হলো না। মূল কলকাতার অদূরে গ্রামীণ মানুষদের হটিয়ে নিউটাউন-রাজারহাট-সল্টলেক নামে আধুনিক উপশহর গড়লেও জ্যোতিবাবু-বুদ্ধদেব বাবুদের দীর্ঘদিনের শাসন প্রদীপের ঠিক নিচের অন্ধকার-অনুন্নয়ন দূর করতে পারেন নি।


মসজিদে ওয়াকফ করা জায়গায় বহুতল ফ্ল্যাট, ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম পায়রাবন্দের বেগম রোকেয়ার (জন্ম: ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০-মৃত্যু: ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২) জীবনের প্রায়-সবটুকু সময় কলকাতায় অতিবাহিত হয়েছে নারী শিক্ষা বিস্তারের সংগ্রামে। বিহারের ভাগলপুরের সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও তিনি দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন লাভ করেন নি। অকালে বিধবা হয়ে তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে স্বামীর সঞ্চিত সম্পদ নিয়ে কলকাতায় এসে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি যে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়েল গার্লস স্কুল’ শুরু করেন, তা শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র ভারত উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম মুসলিম নারী শিক্ষা নিকেতন।

মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়ার প্রথম স্কুলটির অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাই নি। ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসাবে স্কুলের প্রথম বাড়িটির কোনো চিহ্ন রাখা হয় নি। পাশের অনেকগুলো গলি আর পথ ঘুরেও জায়গাটি শনাক্ত করতে পারি নি। নগর কর্তৃপক্ষ বেগম রোকেয়া এবং নারী শিক্ষার এই স্মারকটি রক্ষা করার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেন নি।

১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া মুসলিম বাঙালি নারীদের প্রথম সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। বহু সম্মেলন, সভা, সমাবেশ, আলোচনা তিনি করেছেন এই সংগঠনের ব্যানারের। বাংলার নারী জাগরণের প্রথম দীপশিখাটি তিনি জ্বালিয়েছিলেন কলকাতার পার্ক সার্কাস, শিয়ালদহ-এন্টালি, পার্ক স্ট্রিট এলাকায় এই সংগঠনের মাধ্যমে। দৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ও সাংগঠনিক উপস্থিতির মাধ্যমে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ ব্রিটিশ বাংলায় নারী শিক্ষায় অপরিসীম অবদান রেখেছিল। কিন্তু এই সংগঠনের অফিস বা কাজের চিহ্ন স্বরূপ কোনো স্মৃতি কলকাতার সে তল্লাটে খুঁজে পাওয়া গেলো না। ইতিহাসের মহান অর্জনের ইতিকথা নগর-ইতিহাসের শরীর থেকে যেন কর্পূরের মতো হারিয়ে গেছে।

বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়েল গার্লস স্কুলের অস্তিত্ব এখনো আছে। জীবনের সব কিছু দিয়ে যে স্কুল তিনি গড়ে তুলেছিলেন, তারও রয়েছে বিরাট সংগ্রামের কাহিনী। কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে বেগম রোকেয়ার প্রথম গড়া স্কুলটিকে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে বার বার বাড়ি আর জায়গা বদল করতে হয়েছে। অদম্য রোকেয়া তবু দমে যান নি। চারণের মতো শিক্ষার আলো ফেরি করতে কলকাতার পথে পথে তার ছাত্রীদের নিয়ে লড়াই করেছেন তিনি।


কলকাতার এন্টলিতে বেগম রোকেয়ার বাড়ি, ছবি: বার্তা২৪.কম 

পার্ক স্ট্রিট এলাকার ১৭ নং লর্ড সিনহা রোডে এখন বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়েল গার্লস হাইস্কুলের অবস্থান। শতবর্ষ পেরিয়ে আসা এই ঐতিহাসিক স্কুলের নাম এলাকাবাসীর কাছে শুধুই সাখাওয়াত স্কুল। পাদপ্রদীপের নিচে পড়ে আছে প্রতিষ্ঠাতা বেগম রোকেয়ার নাম।

বঙ্গীয় নারী জাগরণ ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ইতিহাসের মহামানবী হয়েও মূলকর্মক্ষেত্র কলকাতায় প্রায়-বিস্মৃত। ক্ষয়ে যাচ্ছে তার কর্ম ও কীর্তির স্মৃতিঘেরা জায়গাগুলো। পালাবদল ও রূপান্তরের স্রোতে চাপা পড়ছে ইতিহাসের অসংখ্য আলোকিত অধ্যায়।বিশ্বনারী দিবসে কলকাতায় নারী মুক্তির মহান অগ্রদূতের কর্ম ও স্মৃতিসমূহ রক্ষা করার দাবি উত্থাপন খুবই প্রাসঙ্গিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর