হিটলার আসছেন ভারতীয় সিনেমায়!

, কলকাতা

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 04:53:02

বাস্তবে না হলেও পর্দায় তিনি সরব। ইতিহাসের পাতায় ও টিভি-সিনেমার জগতে তার নিন্দিত বা নন্দিত ইমেজের ছড়াছড়ি। বিশ্বের সকল দেশেই তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম বড় ফিল্ম-মার্কেট ভারতে তিনি ছিলেন অনুপস্থিত। মৃত্যুর প্রায় পৌনে এক শতাব্দী পর ভারতে চলচ্চিত্রায়িত হচ্ছেন তিনি। অবশেষে হিটলার আসছেন ভারতীয় সিনেমার বড় পর্দায়!

অ্যাডলফ হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধানতম কুশীলব তিনি। বিশ্বের অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক চরিত্র এই জার্মান নেতাকে নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক বই। নির্মিত হয়েছে ‘দ্য বাঙ্কার’, ‘দ্য ডেথ অব অ্যাডলফ হিটলার’, ‘ডাউনফল’, ‘হিটলার দ্য লাস্ট টেন ডেজ’-এর মতো বহু উল্লেখযোগ্য ছবি। বিবিসি, ডিসকভারি, হিস্ট্রি চ্যানেল তৈরি করেছে তার জীবন ও কর্মভিত্তিক বহু ডকুমেন্টরি। পক্ষে-বিপক্ষে লেখা আর ছবিতে হিটলারকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, হিটলারকে নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র এতো বছরেও নির্মিত হয়নি ভারতের মতো বিরাট সিনেমার বাজারে। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে রাজনীতি নিয়ে অসংখ্য ছবি হয়েছে। রাজনীতির নানা ইস্যুতে তীব্র সংবেদনশীল বহু চলচ্চিত্র থাকলেও হিটলারকে নিয়ে কেউই কোনো ছবি নির্মাণ করেননি।

অবশেষে ভারতের রূপালি পর্দায় আসছেন হিটলার। ইলমাজ সাইদ-এর ছবি 'হিটলার আপসাইড ডাউন'-এ স্বৈরাচারকে দেখা যাবে সেলুলয়েডে। 'ইলমিশকা দুনিয়া' নামক প্রোডাকশন হাউস প্রযোজিত এই ছবিতে হিটলারের ভূমিকায় অভিনয় করছেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়। ছবিটিতে হিটলার ছাড়াও রয়েছে তারা নামক একটি কাল্পনিক চরিত্র। সেই তারার ভূমিকায় অভিনয় করছেন মিশকা হালিম।

আলোচিত-সমালোচিত-স্বৈরতান্ত্রিক হিটলার, ছবি: সংগৃহীত

 

হিটলার ছবিটি সরাসরি ইতিহাসের তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত হচ্ছে না। হিটলারের কাহিনিকে নির্ভর করে ঘটনাপ্রবাহের নতুন বিন্যাস করা হয়েছে। ছবির গল্পে দেখানো হয়, জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে হিমালয়ের উদ্দেশে পাড়ি দেন তারা (মিশকা হালিম)। আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় এই হিটলার সদৃশ এক চরিত্রের সঙ্গে। মিলিটারি পোশাক পরিহিত এবং হিটলারি গোঁফের মালিক এই ব্যক্তি নিজেকে স্বয়ং হিটলার বলে দাবি করেন। ইউরোপের চরিত্র ও ঘটনার হিমালয়ান রূপান্তর ছবিটির প্রতি সকলের মনোযোগ টেনে নিয়েছে।

ছবিতে হিটলারের রাজনৈতিক জীবন ও দর্শনের বদলে প্রাধান্য পেয়েছে তার ব্যক্তিসত্তা। হিটলারের যৌনজীবন নিয়ে দীর্ঘদিন ইতিহাসবিদ এবং পণ্ডিতদের মধ্যে যে বিতর্ক চলেছে, তার ছায়াপাত ঘটেছে ছবিতে। অনেক বিতর্কিত বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রে।

বিশেষত, হিটলার যে একজন উভকামী ছিলেন এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু কিছু গবেষণাধর্মী গ্রন্থে, সেটা পরিচালক ইলমাজ সাইদ গুরুত্বের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। কারণ, ব্যক্তিত্ব-বিশ্লেষণের সাইকোএনালাইসিসে দেখা যায়, হিটলার কাজে-কর্মে-আচরণে নিজেই নিজের বিদ্বেষী হয়ে উঠছিলেন। স্পষ্ট ব্যক্তিগত ও যৌনজীবন তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহু মেয়ের নাম। যাদের মধ্যে দু’জন আত্মহত্যা করেছেন।

বাস্তব জীবনে হিটলার এমন একজন মানুষ, যিনি তার পুরো জীবন অতিউগ্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও রাষ্ট্রের জন্য উৎসর্গ করেছেন। ইভা ব্রাউনের সঙ্গে ছিল তার ১৪ বছরের প্রেমের সম্পর্ক। হিটলার এবং ব্রাউন ১৯৪৫-এ এপ্রিলের শেষ দিকে বিয়ে করেছিলেন এবং আত্মহত্যার আগে পর্যন্ত চল্লিশ ঘণ্টার কম সময় একসঙ্গে ছিলেন। হিটলারের নির্মম ধাঁচের রাজনৈতিক জীবনের পাশে এই ব্যক্তিগত ট্রাজেডিও গবেষণার চিত্তাকর্ষক বিষয়।

ভারতের নির্মাণাধীন হিটলার ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, চলতি বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি অনলাইনে আসতে চলেছে ছবিটি। বক্স অফিস এইচডি অ্যাপে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেখা যেতে পারে এই ছবি। তবে তার আগে সেন্সর নিয়ম মেনে স্ক্রিনিং হবে বড়পর্দায়।

ভারতীয় সিনে মিডিয়ার বরাতে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর-জানুয়ারি নাগাদ শুটিং হয় সিঙ্গালিলা পাহাড়ের বিস্তৃত জায়গায়। সেসময় ওইসব অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে।

চলচ্চিত্রে ও গ্রন্থে হিটলার আলোচিত হয়েছেন নানাভাবে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাবহুল হিটলার জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, জার্মানির বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত নেতা হিটলারের ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। রাশিয়ার রাসপুটিনের পর হিটলার হলেন আধুনিক কালের বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত নেতার প্রতিচ্ছবি।

হিটলারের বিশ্বস্ত জীবনী গ্রন্থসমূহে দেখা যাচ্ছে, এক ভাগ্য বিড়ম্বিত তরুণকে, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ভাইমার প্রজাতন্ত্রে নাৎসি পার্টির নেতৃত্ব লাভ করেন এই অনামা তরুণ। অভ্যুত্থান করতে গিয়ে চরম ব্যর্থও হয়েছিলেন। যে কারণে একসময় তাঁকে জেল খাটতে হয়েছিল।

তথাপি হতোদ্যম হননি হিটলার। বরং জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে আরও তেজের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ প্রচার এবং ইহুদি ও সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করতে থাকেন। একসময় তুমুল জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন তিনি। ইতালির মুসোলিনির 'ফ্যাসিবাদ'-এর আদলে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা করেন চরম উগ্র মতাদর্শ 'নাৎসীবাদ'।

হিটলারের সম্মোহনী 'ক্যারিসমেটিক' নেতৃত্বে জার্মানিতে নাৎসিরা তাদের বিরোধী পক্ষের অনেককেই হত্যা করেছিল, রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়েছিল, সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেছিল এবং সর্বোপরি একটি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।

হিটলার ও ইভা, ছবি: সংগৃহীত

 

উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়ে হিটলার শুধু তার নিজের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে যেসব ঘটনার সৃষ্টি করেছিলেন, সে ভয়াবহ ইতিহাস সকলেরই জানা। ১৯৩৯ সালে জার্মানরা পোল্যান্ড অধিকার করে এবং ফলশ্রুতিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পৃথিবীতে নেমে আসে মৃত্যু ও রক্তের বিভীষিকাময় থাবা এবং পারমাণবিক আতঙ্ক।

সকল কিছুর জন্য হিটলার একাই একমাত্র দায়ী কিনা, সে প্রশ্নও গবেষক মহলে উচ্চারিত হয়। যুদ্ধজয়ী রুশ-মার্কিন-ব্রিটিশ মিত্রশক্তির হাতের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ ও মানবতা কম বিপন্ন হয়নি। তথাপি হিটলারকেই প্রধান দোষী করার একটি প্রবণতা প্রচলিত আছে।

কিন্তু সেই বিতর্কিত হিটলারের রহস্যময় জীবনের সবটুকু জানা সম্ভব হয়নি। কারণ, হিটলারের জীবনে ঘটে যাওয়া বহু তথ্যই এখন পর্যন্ত অজানা ও অনুদ্ঘাটিত রয়েছে। ইলমাজ সাইদ-এর ছবি 'হিটলার আপসাইড ডাউন' এই বিতর্কিত স্বৈরতান্ত্রিক, উগ্র জাতীয়তাবাদী সম্পর্কে কী ধরনের নতুন তথ্য দিতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়। বিশেষত ভারতীয় প্রেক্ষাপটে হিমালয়ের আবহে ইউরোপীয় হিটলারের অজানা অন্তরঙ্গ জীবন দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারে। তদুপরি রাজনৈতিক চমকে ভরপুর ভারতের বিশাল সিনেমা বাজার এই রাজনৈতিক চরিত্রকে কিভাবে গ্রহণ করে, তা-ও সবার মনোযোগের বিষয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর