মাত্র ১৩০০ টাকায় কলকাতার প্রজাস্বত্ত্ব কেনে ইংরেজরা

, কলকাতা

ড. মাহফুজ পারভেজ কন্ট্রিবিউটিং এডিটর বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 04:14:26

বিদ্রোহী শোভা সিংহের অত্যাচারে বাংলার স্বাভাবিক প্রশাসনিক কার্যক্রম ও শান্তি বিঘ্নিত হয়। বিদ্রোহীরা দ্রুত হুগলি ও থানা দুর্গের কাছে চলে আসে। এই দুই জায়গার ফৌজদার ও হুগলি নদীর ধারের জমিদাররা  আক্রমণ প্রতিহত করতে ইংরেজ, দিনেমার ও ফরাসিদের সাহায্যপ্রার্থী হন। এই সুযোগে ইংরেজ বণিকরা তাদের বাণিজ্য কুঠিগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য ঢাকার নবাব ইব্রাহিম খাঁর কাছে অনুমতি চান। নবাবের পক্ষে লিখিত অনুমতি দেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, পূর্ববর্তী রাজকীয় ফরমানে নির্দেশ ছিল যে সুতানুটিতে ইংরেজ বণিক কোনো পাথর বা ইটের বাড়ি বা দেয়াল নির্মাণ করতে পারবে না।

নবাব তখন মৌখিক আজ্ঞা দিয়ে ইংরেজদের নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বলেন। চতুর ইংরেজ এই কথ্য হুকুমের বরাতেই কৌশলে অনেক কিছু করতে থাকে। কালবিলম্ব না করেই তারা সুযোগটি কাজে লাগায়।  ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজরা যথাক্রমে সুতানুটি, চন্দননগর ও চুঁচুড়ায় দুর্গ নির্মাণে তৎপর হয়। শোভা সিংহের বিদ্রোহ ইংরেজদের শক্তি বৃদ্ধিতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে।

তৎকালীন রাজধানী ঢাকা থেকে দূরে সুতানুটির নিভৃত গ্রামে তখনই ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। নবাবের পক্ষে সরেজমিন ঘটনাটি দেখা সম্ভব হয়নি। জমিদারের বিদ্রোহের কবল থেকে রক্ষার জন্য বিরাট দুর্গ নির্মাণের বিষয়টি কোনো প্রয়োজন না থাকলেও ইংরেজরা সংগোপনে সেটা তৈরি করে। চন্দননগর ও চুঁচুড়া অপেক্ষাকৃত জনবহুল ও যোগাযোগের কেন্দ্রে থাকায় সেখানে সামান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনো দুর্গ নির্মিত হয়নি। কিন্তু সুতানুটিতে আস্ত একটি দুর্গই বানিয়ে ফেলে ব্যবসায়ী ইংরেজ। তাদের সুদূরপ্রসারী মতলব তখন অনুধাবন করা সম্ভব না হলেও পরবর্তীকালে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়।

দুর্গের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা আরও জমির মালিকানা হাসিল করতে তৎপর হয়। কারণ, দুর্গ নির্মাণের কাজ দ্রুতবেগে চললেও ইংরেজরা সব সময় চিন্তিত ছিল যে জমিতে তাদের কোনো কায়েমি-স্বত্ত্ব নেই। এই জন্য তারা ভাগীরথী নদীর তীরের সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের পুরোটাই কেনার সিদ্ধান্ত নেয়।

বৃহত্তর কলকাতার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো কেনার ব্যাপারে হুগলির ভূতপূর্ব ফৌজদার জৈনুদ্দীন খাঁ ইংরেজ কোম্পানিকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। তিনি দিল্লির রাজকুমার ফারুকশিয়ারকে রাজি করিয়ে মাত্র ১৬ হাজার টাকা নজরানার বিনিময়ে একটি অনুমতিপত্র আদায় করেন। খোজা সারহাদ নামে এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীও এই বিষয়ে ইংরেজ কোম্পানিকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। অবশেষে সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রামগুলো কেনার অনুমতি পেয়ে ইংরেজ কোম্পানি সাবর্ণ বংশের জমিদার রামচাঁদ রায়, মনোহর রায় প্রমুখের কাছ থেকে মাত্র ১৩০০ টাকায় ওই তিনটি গ্রামের প্রজাস্বত্ত্ব কিনে নেয়।

কলকাতা কেনা-বেচার দলিল করার তারিখ ছিল ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর। পলাশীর প্রায় ৬০ বছর আগেই দূরদর্শী ইংরেজ কলকাতায় নিজেদের জন্য মাটি শক্ত করে পুরো বাংলাকে গ্রাস করতে গোপনে নানা পদক্ষেপ নিতে থাকে।

ভূমির ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে বাংলার সমাজ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারপর তারা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের দিকে অগ্রসর হয়।  

আরও পড়ুন: জব চার্নকের কলকাতা

এ সম্পর্কিত আরও খবর