হাইকোর্টে ৭০১ মৃত্যুদণ্ডাদেশের মামলা বিচারাধীন

, আইন-আদালত

মিজানুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 16:42:55

হাইকোর্টে আগের দশ বছরে তুলনামূলক কম ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির জন্য দায়ের করা হলেও বিগত চার বছরে এ বিষয়ক রেকর্ড পরিমাণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। বর্তমানে হাইকোর্টে ৭০১টি ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারিধীন রয়েছে।

মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ সংক্রান্ত মামলার শুনানির জন্য হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ বৃদ্ধি করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এর আগে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানির জন্য হাইকোর্টে দুইটি বেঞ্চ নির্ধারিত ছিল।

সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্ট বিভাগে একটি বেঞ্চ বৃদ্ধি করেছেন প্রধান বিচারপতি। এছাড়া প্রত্যেক বৃহস্পতিবার পুরনো ফৌজদারী বিবিধ মামলা নিষ্পত্তি করতে কয়েকটি বেঞ্চকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’

মানবাধিকারকর্মী অ্যাড. সুলতানা কামাল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে মৃত্যদণ্ড দেওয়া মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলেই মনে করি। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই মানবাধিকারকর্মীরা আন্দোলন করে আসছেন। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মাথায় নিয়ে কারাভোগের পর একজন আসামি খালাস পাওয়ার পর সে যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করেছে এ দায় কার?’

গত চার বছরে বেড়েছে ডেথ রেফারেন্স মামলা

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ডেথ রেফারেন্স শাখার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিচারিক আদালত থেকে উচ্চ আদালতে মোট ডেথ রেফারেন্স মামলা দায়ের করা হয়েছে ৪৪১টি।

অন্যদিকে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মামলা দায়ের করা হয়েছে ৬০০টি। প্রায় দেড়গুণ মামলা বেশি দায়ের করা হয়েছে এই চার বছরে। এছাড়া চলতি বছরে ৮৩টি ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে, যা গত চার বছরে সর্বোচ্চ।

‘ঢালাও মৃত্যুদণ্ডে বহির্বিশ্বে দেশের মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. খন্দকার মাহবুব হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ঢালাও মৃত্যুদণ্ডাদেশের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মানবাধিকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ড রদ করা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে উচ্চহারে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হচ্ছে। জঘন্যতম অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ড হলেও এক মামলায় ১০/১২ জনকেও একই সাজা (ফাঁসি) দেওয়া হচ্ছে।’

এই আইনজীবী জানান, নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার পর এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য হাইকোর্টে আসে। মামলাজটের কারণে ডেথ রেফারেন্সের মামলা পুনর্বিবেচনার লোকবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বিজ্ঞ বিচারপতির অভাব ছাড়াও ফৌজদারী অপরাধের বিচার করতে অনেক বিচারপতির অনীহাও দেখা যায়।

বিচারিক আদালতকে সতর্ক করার পরামর্শ

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্যে অনেক রায় দেওয়ার নজির আমাদের দেশে রয়েছে, যেসব রায় পরবর্তীতে হাইকোর্টে এসে বদলে যায়। ঢালাও মৃত্যুদণ্ডের রায় হ্রাস করার জন্য আদালতগুলোতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও ফৌজদারী অপরাধ বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারক নিয়োগ করতে হবে।’

ডেথ রেফারেন্স শাখার তথ্যানুযায়ী, ২০০৪ সালে দায়েরকৃত ডেথ রেফারেন্স মামলার পরিমাণ ছিল ১৭৪টি। ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ১৭৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এর পরের বছরগুলোতে কমতে থাকে এই মামলার সংখ্যা ২০০৬ সালে ১১২টি, ২০০৭ সালে ১০২টি, ২০০৮সালে ১৩৭টি, ২০০৯ সালে ৮৩টি, ২০১০ সালে ৭৬টি, ২০১১ সালে ৬৭টি, ২০১২ সালে ৬০টি, ২০১৩ সালে ৬৩টি এবং ২০১৪ সালে ৯২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) সুপারিশে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পেলেও উচ্চ আদালতে গিয়ে অনেকে খালাস পাচ্ছেন বা সাজা কমে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘কারাগার থেকে তথ্য নিয়ে দেখেছি, ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩৫টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হার অনেক কম, সেহেতু মৃত্যুদণ্ড রহিত করতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি। এছাড়া আমি মনে করি বিচারিক আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হলে ধাপে ধাপে মৃত্যুদণ্ডের পরিমাণ কমে আসবে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর