ইতিহাস বিকৃতির দায়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন শুভংকর সাহা

, আইন-আদালত

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 03:20:11

বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে ইতিহাস বিকৃতির দায়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন বইটির সম্পাদক শুভঙ্কর সাহা। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি। তবে আদালত এ বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি।

আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এ বি এম আলতাফ হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আল আমিন সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আজিজ উল্লাহ ইমন এবং শুভঙ্কর সাহার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যোবায়ের রহমান।

আইনজীবী আজিজ উল্লাহ ইমন পরে সাংবাদিকদের বলেন, এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আভ্যন্তরীণ নোটিশ দিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সমস্ত কপি তুলে নিয়েছে। আর নতুনভাবে প্রকাশিত বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।

বইটি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান কমিটি প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি না ছাপিয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি ছাপানোর ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে শুভঙ্করকে তলব করে। সেই সাথে ইতিহাস বিকৃতি ‘অমার্জনীয় অপরাধ’ মন্তব্য করে আদালত বইটির পুরনো কপি তুলে নিতে বলেছিল।

সে আদেশের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার হাইকোর্টে হাজির হয়ে ইতিহাস বিকৃতির দায় স্বীকার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চান শুভঙ্কর সাহা।

শুভঙ্কর সাহা আদালতে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বই প্রকাশে একটি টিম দায়িত্বে ছিলেন। আমরা বইয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদান, ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কিত বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি না পাওয়ায় বইয়ে বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি দেওয়া হয়নি। এইজন্য আমি আদালতের কাছে পুরো টিমের পক্ষে ক্ষমা চাচ্ছি।

এ সময় আদালত বলেন, আইয়ুব খান, মোনায়েম খানকে বইতে হাইলাইট করলেন, অথচ বঙ্গবন্ধুর একটা ছবিও পেলেন না?

শুভঙ্কর সাহা বলেন, বইতে আইয়ুব খানকে স্বৈরাচার হিসেবেই অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে।

এ সময় আবারও দুঃখ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে রিটকারী আইনজীবী এ বি এম আলতাফ হোসেন বলেন, ক্ষমা চেয়ে ইতিহাস বিকৃতির দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। জাতি ক্ষমা করতে হবে।

এরপর আদালত প্রকাশিত ওই বইগুলো কী করা হয়েছে, তা হলফনামা আকারে বিস্তারিত জানানোর নির্দেশ দিয়ে আগামী ৯ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির তারিখ দেন।

রিটকারী পক্ষের আইনজীবী এ বি এম আলতাফ হোসেন বলেন, ইতিহাস বিকৃতির দায় স্বীকার করে শুভঙ্কর সাহা নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি চাইলেও, আদালত তা গ্রহন করেননি। ফলে পরবর্তী তারিখে তাকে আসতে হবে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বইটি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’বইয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি ছাপা হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি না ছেপে ‘ইতিহাস বিকৃতি’ করা হয়েছে।

আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে ২০১৩ সালে এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি ও প্রকাশনার সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে উপদেষ্টা কমিটি ও সম্পাদনা কমিটি নামে দুটি কমিটি করা হয় সে সময়।

বইটি প্রকাশের আগে সম্পাদনার দায়িত্বে বেশ কয়েকবার রদবদল হয়। সর্বশেষ এ দায়িত্বে ছিলেন ব্যাংকের তখনকার নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভংকর সাহা। তার আগে দায়িত্ব পালন করেন আরেক নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মাহাফুজুর রহমান। তারা দুজনই অবসরে গেছেন।

পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করার পর ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’। ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ অনুষ্ঠানিকভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির। এরপর সেপ্টেম্বরে একটি জাতীয় দৈনিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি না থাকা বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর বইটির বিতরণ বন্ধ করার নির্দেশ দেন গভর্নর। পাশাপাশি বইটি নতুন করে সম্পাদনা করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে দেন।

এরই মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন যুক্ত করে এফবিসিসিআই পরিচালক কাজী এরতেজা হাসান হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।

প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছর ২ অক্টোবর হাইকোর্ট ইতিহাস বিকৃতি অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে রুলও জারি করা হয়।

‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ গ্রন্থে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অন্তর্ভুক্ত না করে ইতিহাস বিকৃতি করা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বর্হিভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

হাইকোর্টের নির্দেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অর্থ বিভাগ) মো. জাফর উদ্দীনকে আহবায়ক করে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি সোমবার তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নামকরণ করেন। গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিবৃত রয়েছে। এ কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যক ছিল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর