আবুল খায়ের গ্রুপের ২০০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি

, আইন-আদালত

নাজমুল আহসান রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-30 23:09:39

নামীদামি প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির ৭ হাজার ১৫২ মামলা বিচারাধীন রয়েছে উচ্চ আদালতে। এরমধ্যে রয়েছে শুল্ক (কাস্টমস) ফাঁকির ২৫২৮ টি আপিল এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ফাঁকির ৭৬০টি আপিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে রিট রয়েছে ৩ হাজার ৮৬৪টি।

উচ্চ আদালতে এসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে ধীরগতিতে। গত জুন মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৩টি মামলা। চলতি বছরের মে মাসে ৮টি কাস্টমস ও একটি ভ্যাট মামলা এবং জুন মাসে তিনটি কাস্টমস এবং একটি ভ্যাট মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে।

তবে মামলাগুলোর বিপরীতে সঠিক আর্থিক পরিমাণের তথ্য পাওয়া না গেলেও আনুমানিক ৪ হাজার কোটি টাকা আর্থিক বিষয় জড়িত বলে জানা গেছে।

এক আবুল খায়ের গ্রুপের ৫৪ আপিলের বিপরীতেই ২০০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির বিরুদ্ধে আপিল করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫৪ টি আপিলের বিপরীতে ২০০ কোটি শুল্ক ফাঁকির আপিল করেছে চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার।

জানা গেছে, আবুল খায়ের গ্রুপ, হোলসিম সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেড, বাটারফ্লাই মাকেটিং লিমিটেড, মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড, এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন লিমিটেড, হোটেল কস্তুরি প্রাইভেট লিমিটেডসহ দেশের নামী কোম্পানিগুলোর আপিল ও রিট বিচারাধীন রয়েছে।

বিচারাধীন মামলার মধ্যে ২০১১ থেকে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের আপিলের সংখ্যা বেশি। মাঝে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের প্রায় মামলা হয়েছে। চলতি বছর দায়ের করা মামলা এখনো শুনানির জন্য কার্য তালিকায় আসেনি।

রাষ্ট্রপক্ষে শুল্ক ও ভ্যাট আপিল এবং রিট মামলাকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল প্রতিকার চাকমা বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে জানিয়েছেন, রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পক জড়িত থাকায় অ্যাটর্নি  জেনারেল অফিস সব সময় শুল্ক ও ভ্যাটের মামলায় গুরুত্ব দিচ্ছে। একারণে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের আপিল ও রিট শুনানির অপেক্ষায় নেই বললেই চলে। এরআগের মামলাগুলোর পর্যায়ক্রমে শুনানির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তিনি জানান, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বা আপিলকারী পক্ষ যোগাযোগ করলে আমরা তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

বর্তমানে হাইকোর্টের দুটি দ্বৈত বেঞ্চে এবং দুটি একক বেঞ্চে কাস্টমস আপিল ও রিটে আবেদনের শুনানি হচ্ছে। চলতি বছরে মে মাসে ২৫২৫ টি কাস্টমস আপিল এবং ৭৫৩টি ভ্যাট আপিল বিচারাধীন ছিল। মে ও জুনের এক মাসের তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৩টি কাস্টমস আপিল এবং ৭টি ভ্যাট আপিল যোগ হয়েছে পরবর্তী মাসে।

আপিল আবেদন থেকে দেখা যায়, চীন থেকে ‘কেলন’ ব্যান্ডের রেফ্রিজারেটর আমদানির বিষয়ে ২০১৫ সালে আপিল করেন বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার আগে ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল রাজধানীর কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল বাটার ফ্লাই মার্কেটিংয়ের করা আপিল খারিজ করে দেয়।

বাটারফ্লাই মার্কেটিং ‘কেলন’ ব্র্যান্ডের ৩১২ ইউনিট রেফ্রিজারেটর আমদানি করে ২০১০ সালে। সঙ্গে খুচরা যন্ত্রাংশও ছিল। মূল্য ১৫ হাজার ৬০০ ডলার। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক সম্পন্ন করে এগুলো আমদানি পর কমলাপুর আইসিডি থেকে এসব পণ্য খালাস করতে ২০১১ সালের ২১ মাচ বিল জমা দেয় কোম্পানিটি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্য সরেজমিন পরিদর্শন করে মান, পরিমাণ ও পণ্যের কোড যাচাই করে।

আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ৫ লাখ ৯৩ হাজার ১০৮ টাকার শুল্ক আরোপ করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে বেসিক ব্যাংকের গ্যারান্টি দেখিয়ে পণ্য খালাস করে বাটারফ্লাই। পণ্য খালাসের পর তারা কাস্টমস (আপিল) কমিশনারের কাছে আবেদন করে। আবেদনে কোম্পানিটি দাবি করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে পণ্যেও মূল্য নির্ধারণ করেছে। কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি ছাড়া এবং আইন বর্হিভূতভাবে এ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চালানের ভিত্তিতে মূল্য পুননির্ধারণের জন্য বাটারফ্লাই আবেদন করে। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর কাস্টমস কমিশনার তাদের আবেদন খারিজ করে দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হলে ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালেও তা বহাল থাকে।

হোলসিম সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেড তাদের ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে। ঢাকার কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দেওয়া রায়ে ওই জরিমানা বহাল থাকলে তারা এ চ্যালেঞ্জ করে।

সিমেন্ট উৎপাদন আরো বাড়াতে আরেকটি কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক মতিঝিল শাখার মাধ্যমে ভারত থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করে হোলসিম। আমদানিকৃত যন্ত্রপাতির মূল্য এক কোটি ৫৩ লাখ ৫ হাজার ৬৭৯ ডলার।

এলসি খোলার পর ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি হোলসিম আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে রেয়াত পেতে আবেদন করে এনবিআরে। ১৭ জানুয়ারি রেয়াতের আবেদনে সাড়া দিয়ে একটি চিঠি ইস্যু করে এনবিআর। যন্ত্রপাতি আসার পর নারায়নগঞ্জ বন্দরে তা খালাসের জন্য বিল জমা দেওয়া হলে এইচএস কোডের ভিত্তিতে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

খালাসের পর ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ১৩৩ টাকা শুল্ক দাবি করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় হোলসিমকে। কেন আপিলকারীর বিরুদ্ধে শাস্তি আরোপ করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয় নোটিশে। পরে আইন লঙ্ঘনের দায়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আপিল করলে সেখানেও তা বহাল থাকে।

আবুল খায়ের স্টিল প্রোডাক্টস লিমিটেড জাপান থেকে প্রাইম কোয়ালিটির ইলেকট্রোলাইট টিন প্লেট আমদানি করে ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। পণ্য খালাসের জন্য বিল জমা দেওয়ার পর প্রতি টন ২৭০ ডলার মূল্যের পরিবর্তে ৩০০ ডলার মূল্য নির্ধারণ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরপর পণ্য খালাস করে কাস্টমসের রিভিউ কমিটির কাছে আবেদন করে আবুল খায়ের স্টিল। ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট রিভিউ কমিটি অতিরিক্ত নেওয়া অর্থ আবুল খায়ের স্টিলকে ফেরত দিতে কাস্টমসকে নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালেও তা বহাল থাকে ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আপিল করেন কাস্টমস কমিশনার (আমদানি)।

রাজধানীর পুরানা পল্টনের হোটেল কস্তুরি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আহমেদের ভ্যাট ফাঁকির একটি আপিল বিচারাধীন রয়েছে হাইকোর্টে। ৯ লাখ ২৬ হাজার ৫৩৭ টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে শুল্ক গোয়েন্দা ইউনিটের কর ধার্যের বিরুদ্ধে তিনি আবেদন করলে ২০১৮ সালের ৪ জুন কাস্টমস কমিশনার তা খারিজ করে দেন। এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে চলতি বছর ২৫ মে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে কাস্টমস কমিশনারের আদেশ বহাল থাকে। ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৪ জুলাই হোটেল কস্তুরির মালিক কাওসার আহমেদ এ আপিল দায়ের করেন।

সেনা কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠান মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেডের ক্লিংকার আমদানির বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল করা হয়েছে হাইকোর্টে। ক্লিংকার আমদানিতে ১ শতাংশের পরিবর্তে কাস্টমস ২ শতাংশ শুল্ক মূল্য নির্ধারণ করলে তাতে অসন্তুষ্ট মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আইনি লড়াইয়ে নামে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর