সাত বছরে ২৬৫১ মামলা সাজা ১৫টিতে

, আইন-আদালত

নাজমুল আহসান রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-23 19:22:30

সারা দেশের সব সাইবার অপরাধের বিচার চলছে রাজধানীর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে। সাত বছরে আগে ২০১৩ সালে এই ট্রাইব্যুনাল যাত্রা শুরু করে। বিচারকাজ চলে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে। শুরুর দিকে মামলা নিষ্পত্তিতে ঢিমেতাল থাকায় প্রথম রায় আসে ২০১৪ সালে। গত দুই বছর বেড়েছে মামলা নিষ্পত্তির হার। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর বেড়েছে মামলার সংখ্যাও। সব মিলে সাত বছরে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৬৫১টি। এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেক এক হাজার ৫৯টি নিষ্পত্তি হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ১৫ মামলায়। আসামিরা খালাস পেয়েছেন ৯১টিতে।

অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার, মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শনের জন্য অশ্লীল ছবি ও ভিডিও প্রচারের সাজা চাওয়া হচ্ছে বেশিরভাগ মামলায়। ডিজিটাল মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, স্কাইপ, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ইউটিউব ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এসব ঘটনা ঘটছে। স্বামী স্ত্রীর পারিবারিক বিরোধ ও প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদের পর এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ‘দেখে নেওয়ার’ জন্য যায় সাইবার মামলায়। এ ধরনের মামলাই বেশি। আবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হয়েও মামলা করেন অনেকে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, ২০০৬ এর অধীনে সাইবার ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরুর পর গত বছরের ৮ অক্টোবর চারটি ধারা বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত ২ হাজার ২৫৫ মামলা হয়েছে। আইসিটি আইনের এসব মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৫৮টি। এর মধ্যে মাত্র ১৫টি মামলায় সাজা হয়েছে, ১৯ জনের। খালাস পেয়েছেন ৯১ জন। আইসিটি আইনে এখনো বিচারাধীন এক হাজার ৩৯৭ মামলা।

সূত্র জানায়, ২ হাজার ২৫৫ মামলার মধ্যে সারা দেশের থানাগুলোতে হয় ২ হাজার ৪৮টি, আর রাজধানীর ট্রাইব্যুনালে হয়েছে ২০৬টি। নিষ্পত্তি হওয়া ৮৫৮ মামলার মধ্যে সরাসরি খারিজ (একতরফা) হয়েছে ৬২১ মামলা। বাদী বিবাদীর (দোতরফা) শুনানি শেষে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩১ মামলা।

২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর গত ১১ মাসে ৩৯৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৫টি ট্রাইব্যুনালে, বাকী ৮১টি বিভিন্ন থানায়। নতুন এই আইনে ২০১টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও রায় হয়নি একটিতেও। খালাস বা সাজাও পাননি কোনো আসামি। ট্রাইব্যুনাল একতরফাভাবে সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন ১৯৭ মামলা। চারটি মামলা খারিজ হয়েছে দোতরফায়। বিচারাধীন রয়েছে ১৯৫ মামলা। গত ১৯ আগস্ট সাইবার ট্রাইব্যুনাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠানো নথিপত্র বিশ্লেষণে এসব তথ্য পেয়েছে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম।

২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা প্রদানের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। দীর্ঘদিন এ আইনের প্রয়োগ হয়নি। ট্রাইব্যুনালও ছিলনা।

২০১৩ সালে দুই দফায় বড় ধরণের সংশোধন আনা হয় আইনে। ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা সংশোধন করে ডিজিটাল বিন্যাস ও সাজা বাড়ানো হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি (৯০ শতাংশ) মামলা হয়েছে ‘বিতর্কিত’ ৫৭ ধারায়।

এমন পরিস্থিতিতে সমালোচনার মুখে সরকার গত বছর ৮ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করে। নতুন আইনে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারার বিলুপ্তি ঘটে।

২০১৩ সালে দুই দফা আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল আইসিটি আইনের একটি মামলার বিচার নিয়ে। পুলিশ অভিযোগপত্র দেওয়ার পর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত তা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেন। এখতিয়ার না থাকায় দায়রা আদালত শুনানি করতে পারছিলেন না। এরপর সরকার ওই বছর সাইবার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে। সেখানে মামলাটি শুনানির জন্য আসে।

আইসিটি আইন কার্যকর থাকা পর্যন্ত ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে ৯০ শতাংশ। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রণয়নের পর আগের ৫৭ ধারা ভেঙে চারটি পৃথক ধারা করা হয়েছে। এখন আগের মতো একক কোনো ধারায় নয়, একাধিক ধারায় মামলা হচ্ছে।

প্রথম রায়ে ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট আসামি জুয়েলকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ৫৭ (২) ধারায় ৭ বছর কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। একই বছর দ্বিতীয় রায়ে শাহীন শেখকে ৭ বছর কারাদণ্ড ও সাত হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

সর্বশেষ চলতি বছর ৯ জানুয়ারি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলায় মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে সাত বছর কারাদণ্ড দেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ছবি বিকৃত করার অভিযোগে সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ রায় দেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের তিনদিন পর ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম মামলাটি করা হয় রাজধানীর পল্টন থানায়। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র তৈরি করে তা বিক্রির অভিযোগে আটক পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

দ্বিতীয় মামলাটি হয় চট্টগ্রামে। আবুল কাসেম নামে বিএনপির এক সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলাটি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় এ মামলা করেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আবু তালেব। মামলার পরপরই আবুল কাসেমকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম (শামীম) বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, শুরুতে মামলা নিষ্পত্তি কম হয়েছে। এখন দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। বাদী আপোষ রফার মাধ্যমে আদালতে এসে বলছেন আসামির বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নেই। এতে আদালতের কিছু করার থাকে না। আদালত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেন। সাক্ষ্যের পর্যায়ে এসে বাদী কিছু বলতে না চাইলে মামলা খারিজ হওয়াই স্বাভাবিক।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মোট মামলার ১৯ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে এটা স্পষ্ট মামলাগুলো হয়রানিমূলক ছিল। এ কারণে কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। এখন মামলার বিবাদী পক্ষ মিথ্যা মামলার অভিযোগে আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর