পুলিশের ফাইনাল রিপোর্টেই শেষ ৩৩৪ মামলা

, আইন-আদালত

নাজমুল আহসান রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-31 14:23:31

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি) ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮১৮টি মামলা একতরফা নিষ্পত্তি হয়েছে। এরমধ্যে ৩৩৪টিরই ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে পুলিশের ফাইনাল রিপোর্টে (চূড়ান্ত প্রতিবেদন)। পুলিশ অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি এসব মামলার কোনো আসামিকে। এর মধ্যে আইসিটি আইনের মামলা ২৭৯টি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫৫টি।

বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দুইপক্ষের শুনানিতে দোতরফা ভাবে যে ১৩৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে আইসিটির মামলা ১৩১টি এবং ডিজিটাল আইনের ৪টি। একতরফা ও দোতরফা মিলিয়ে সাজা ছাড়া শেষ হয়েছে ৯৫৩টি মামলা। সাত বছরে দুই আইনের মোট ২ হাজার ৬৫১ মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ১৫টিতে ১৯ জনের। সাজার হার প্রায় ৪ শতাংশ। ৯১টি মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, মামলার অভিযোগ প্রমাণে প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষ) ব্যর্থতার পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগ, পুলিশি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়া (ফাইনাল রিপোর্ট), দুর্বল পুলিশি তদন্তে দায়সারা অভিযোগপত্র, সাক্ষী হাজিরের পর যথাযথ সাক্ষ্য না দেওয়া ও সাক্ষীদের ডিজিটাল মাধ্যমের সম্পর্কে ধারণা না থাকায় একতরফা মামলা নিষ্পত্তি, অব্যাহতি, সাজা কম এবং খালাসের ঘটনা ঘটছে। এসব কারণে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও অপরাধ প্রমাণ করা যাচ্ছে না। এতে প্রকৃত অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় এটা স্পষ্ট যে মামলাগুলোর অভিযোগ ছিল ‘মিথ্যা’। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা ও হয়রানির জন্য মামলাগুলো করা হয়েছিল। আদালতের উচিত মিথ্যা মামলার দায়ে বাদী পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এজন্য আসামিপক্ষও ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারে। কারণ, মামলার পর কোনো না কোনো পর্যায়ে আসামিকে কারাগারে যেতে হয়েছে।

প্রসিকিউশনও তাদের দূর্বল পুলিশি তদন্ত এবং সক্ষমতার অভাব ও মিথ্যা মামলার বিষয়টি স্বীকার করেছে। কিন্তু মিথ্যা মামলার শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বা মামলা করার বিধান রাখা হয়নি এই দুই আইনের কোনোটিতে। তাই ট্রাইব্যুনালকেও মিথ্যা মামলার অভিযোগে বাদীপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

আইসিটি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- ডিজিটাল ফরেনসিক প্রতিবেদন, প্রচারিত ইউআরএল ও আলামত। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিজিটাল মাধ্যমের জ্ঞানের অভাবে অধিকাংশ সময় গতানুগতিক মামলার মতো দায়সারা অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে এসে তখন অপরাধের কোনো উপাদানই খুঁজে পান না ট্রাইব্যুনাল। ফলে মামলা খারিজ হয় বা আসামিরা দায় থেকে অব্যাহতি পান।

আরও পড়ুন: সাত বছরে ২৬৫১ মামলা সাজা ১৫টিতে

আইসিটি ও ডিজিটাল আইনে অভিযোগপত্র দেওয়ার পরই মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর পর শুরু হয় মুল বিচার প্রক্রিয়া।

ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুলিশের ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) দাখিলের পর তা ট্রাইব্যুনালে গেলে শুনানির দিন ধার্য করা হয়। ধার্য দিনে বাদীপক্ষ আপত্তি না জানালে (নারাজি) সেটি গৃহীত হয় ট্রাইব্যুনালে। আর নারাজি আবেদন করলে কখনো কখনো অধিকতর তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। গত সাত বছরে নারাজি আবেদন পড়েছে ২৫ মামলায়। কিছু মামলায় বাদীপক্ষের নারাজি আবেদন নামঞ্জুর করেছে ট্রাইব্যুনাল।

নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে ১৫টি মামলায় রায় হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটিতে মূল আসামির সাজা হলেও বাকি সবাই খালাস পেয়েছেন।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, চারভাবে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে সাইবার ট্রাইব্যুনালে। সেগুলো হচ্ছে পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, হয়রানির বা প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং গতানুগতিক অভিযোগের মামলা আমলে না নিয়ে সরাসরি খারিজ আদেশে, দুই পক্ষের শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের উপাদান না পেলে আসামিকে অব্যাহতির মাধ্যমে এবং অভিযোগ গঠনের পর দুইপক্ষের শুনানি শেষে সাজা বা খালাসের রায়ে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম (শামীম) বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, বেশিরভাগ মামলা আপোষে নিষ্পত্তি হচ্ছে। বাদী-বিবাদীরা আপোষ করে আদালতে আসেন। যখন আদালতের বাইরে আপোষ হয় তখন সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে এসে বলেন ‘আমি ভুল বুঝে মামলা করেছিলাম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই।’ সাক্ষীর এ ধরণের বক্তব্যে আদালত মামলা নিস্পত্তি করে দেয়।

অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় নিষ্পত্তি করা মামলাগুলো মিথ্যা মামলা কিনা চানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই মিথ্যা মামলা। এ কারণে আদালত, পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআইর মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে।

পুলিশের গাফিলতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের তদন্তে অবহেলা আছে, পারদর্শিতা ও অভিজ্ঞতার অভাব আছে। তাদের সক্ষমতার অভাবের বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আশা করি, আস্তে আস্তে এসব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, সাইবার অপরাধের মামলায় প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন। তদন্ত কর্মকর্তাদের এটার ঘাটতি ছিল। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর