শ্রম আদালতে মামলা জট, বিচারাধীন ১৪ হাজার

, আইন-আদালত

নাজমুল আহসান রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 16:15:24

শ্রম বিরোধ ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দেশের ৭টি শ্রম আদালতে করা ১৪ হাজার ২৪২টি মামলা বিচারাধীন। পাঁচ বছর ধরে ঝুলছে ২ হাজার ২২টি মামলা। চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এই সাতটি আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৯৫৮টি মামলা। আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৩টি। ধীরগতির বিচারের কারণে শ্রমজীবী বিচারপ্রার্থীরা কাঙ্খিত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বিচারাধীন এসব মামলা বেশীরভাগই গার্মেন্ট খাতের শ্রম বিরোধ ও শ্রম আইন লঙ্ঘন থেকে উদ্ভূত। কারখানা বন্ধ ঘোষণা, চাকরিচ্যুতি, অবসরের পর সুবিধাদি না দেওয়া, বেতন আটকে রাখা, বিলম্বে বেতন দেওয়ার অভিযোগে করেছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারক না থাকা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে বিলম্ব, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে বিলম্বের কারণে শ্রম আদালতে মামলার বিচার ঝুলে আছে।

শ্রম আইনে ৬০ কার্যদিবসে মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকলেও ছয় মাসেও নিষ্পত্তি হয়নি এমন মামলা রয়েছে মোট মামলার ৬০ ভাগ। এই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় পাওয়া যায়। শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সংক্ষুব্ধ হলে ঢাকায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিলের সুযোগ আছে।

সূত্র জানিয়েছে, ১৪ হাজার ২৪২টি মামলা বিচারাধীন শ্রম আদালতে। এরমধ্যে ছয় মাস ধরে ঝুলছে ১০ হাজার ৮৩৮ মামলা। তিন মাসের বেশী সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৬৪৯৫ টি মামলা। আর এক মাস ধরে আছে ৩২৭৫টি মামলা। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ১০৬৫টি আপিল বিচারাধীন।

ঢাকার তিনটি শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ১০ হাজার ৭৯৮টি মামলা। আর চট্টগ্রামের প্রথম শ্রম আদালতে ১৪৯৫টি, দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৫৭৮টি। রাজশাহীর শ্রম আদালতে ১২৯টি এবং খুলনার শ্রম আদালতে বিচারাধীন ১৭৭টি মামলা বিচারাধীন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে ১৭২টি মামলা।

ঢাকার তিনটি শ্রম আদালতে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ১০৭৫টি মামলা। চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৬৫টি। রাজশাহী শ্রম আদালতে ৩৭টি ও খুলনার আদালতে ১৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।

ঢাকার শ্রম আদালতে পাঁচ বছরের বেশি পুরনো মামলা রয়েছে ৮৪২টি। চট্টগ্রামের আদালতে ছয় বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ১০০৮টি মামলা। রাজশাহী ও খুলনার আদালতে পাঁচ বছর ধরে ঝুলছে ১৩টি করে ২৬টি মামলা।

অন্যদিকে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে ১০৬৫টি মামলা। ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৩টি আপিল। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন ১৪৬টি আপিল। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ২৩৪টি আপিল।

গার্মেন্ট শ্রমিক নুরুল আমিন কাজ করতেন রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার পর ২০১৮ সালের ১ জুলাই চাকরিচ্যুত করা হয় আইয়ুবকে। চাকরিচ্যুত করা হলেও গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট তহবিলের কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি তাকে। এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেন তিনি। গত বছর ১ নভেম্বর মামলা করলেও এখনো তার মামলাটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি।

নারী গার্মেন্টস শ্রমিক আলেয়া খাতুনসহ ১০ জন মামলা করতে আসেন রাজধানীর আশুলিয়া থেকে। সেখানে এপেক্স ডেনিম নামে একটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করতেন। প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছর ‘লে অফ’ ঘোষণা করলে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কর্তৃপক্ষ কোনো ধরণের ক্ষতিপূরণ দেয়নি তাদের। উল্টো দুই মাসের বকেয়া রয়েছে তাদের। বকেয়া পাওয়া ও ক্ষতিপূরণ পেতে তারা শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।

১৯৮৭ সালের ১৫মে বেসরকারি দি সিটি ব্যাংকে টাইপিস্ট পদে যোগ দেন মো. আবুল হাশেম মজুমদার। পরে তিনি জ্যেষ্ঠ কম্পিউটার অপারেটর পদে পদোন্নতি পান। ২০১৩ সালের ৮মে তাকে পদ থেকে চাকরিচ্যুত করা হলে তিনি শ্রম আদালতে মামলা করেন। শ্রম আইন ২০০৬ এর ৩৩(১) ধারায় করা মামলায় তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল এবং প্রাপ্য সুবিধাদি ফেরত দেওয়ার আর্জি রয়েছে। শ্রম আদালতে তিনি চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ পেলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপিল করায় তা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এরমধ্যে চাকরি হারানোর ৬ বছর গড়িয়েছে তার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা রয়েছে ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার। যারা মূলত সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় নিয়মিত শ্রম দিয়ে থাকেন। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে পাট, টেক্সটাইল, চিনি, কাগজ, গার্মেন্টস, হালকা যান, পরিবহন, ট্যানারি, চা ও নৌযান শ্রমিক।

শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অধীর চন্দ্র বালা বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, মামলার তুলনায় আদালত কম। ফলে মামলা দায়ের হচ্ছে বেশি কিন্তু আদালত কম থাকায় বেশিরভাগই বিচারাধীন থেকে যাচ্ছে। আবার মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ ও সাক্ষী না আসার কারণে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আদালতের সংখ্যা বাড়ানো হলে মামলা নিষ্পত্তি বাড়বে বলে মনে করেন এ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর