রায় ভিন্ন দিকে ঘোরাতে চেয়েছিল আসামিরা

, আইন-আদালত

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-18 09:01:57

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অপরাধের বিষয়ে চার্জগঠনের পর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণের কোনো পর্যায়ে আসামির কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হওয়ার পর আইন তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়। সে সময় আসামি নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্য ডকুমেন্টস দাখিল করতে পারেন। কোনো কথা বলার থাকলে বলতে পারেন। কিংবা তার সমর্থনে আদালতে কোনো সাক্ষী হাজির করতে চাইলে সে সুযোগ পেতে পারেন।

গত ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার আগে ৩০ অক্টোবর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন ধার্য ছিল। তারও আগে চার্জশিটের ২১১ সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ নেয় ট্রাইব্যুনাল। সাক্ষ্যগ্রহণের সময়ই আসামিরা বুঝে যায় মামলার রায় কী হতে পারে। শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা রায় ভিন্নদিকে ঘোরানোর পরিকল্পনা করে। আর এজন্য তারা বেছে নেন ৩০ অক্টোবর আত্মপক্ষ সমর্থনের দিনকে।

হলি আর্টিজান মামলার রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ট্রাইব্যুনালে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দিয়ে রায় ভিন্ন দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেন। অন্য আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখিতভাবে বক্তব্য দিলেও রাজীব গান্ধী মৌখিকভাবে তার বক্তব্য ট্রাইব্যুনালে উত্থাপন করেন। কৌশলী বক্তব্যে তিনি হলি আর্টিজান হামলার আগের দিন পর্যন্ত বসুন্ধরার সেই বাড়িতে (যে বাড়িতে আত্মঘাতী ৫ সদস্য ছিলেন) অবস্থানের কথা বললেও হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণের কথা এড়িয়ে যান। একইসঙ্গে অপর জঙ্গিদের বাঁচানোরও চেষ্টা করেন তিনি।

ওইদিন রাজীব গান্ধী ট্রাইব্যুনালে বলেন, আমি ২০০২ সালে জেএমবিতে যোগদান করি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করি। এ সময় ইরাক ও সিরিয়ায় খেলাফত ঘোষণা করা হলে আমি তামিম চৌধুরী ও সরোয়ার জাহানের মাধ্যমে বায়াত (অনুগত্য স্বীকার) গ্রহণ করি। তারা আমাকে আইএস’র উত্তরবঙ্গ শাখার দায়িত্ব দেন।

রাজীব গান্ধী বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর উত্তরবঙ্গে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করি। জাপানি নাগরিক হোশে কুনিও এবং কুড়িগ্রামে মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হওয়া হোসেন আলীকে হত্যা করি। এরকম বেশ কিছু অভিযান আমি পরিচালনা করি।

২০১৬ সালের ১ মার্চ মারজান আমাকে থ্রিমা অ্যাপসের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জের ফুড ভিলেজ হোটেলে ডেকে নেন। তাদের নিয়ে আমি বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করি। ওই বছরের ১৬ মে মেজর জাহিদ এপসের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জের একটি হোটেলে আমাকে দেখা করতে বলেন। ওখানে স্বপন, বাধন, উজ্জানসহ তিনজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে মেজর জাহিদ তাদের নিয়ে চলে যান। আমি জানতে পারি গুলশানে একটি হামলার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণে নতুন পরিচিত মেজর জাহিদ, সারোয়ার, মানিক তারাও ছিলেন।

ওই বছরের ২০ মে তামিম চৌধুরী আমাকে চিড়িয়াখানা ডেকে নেন। সেখানে তামিম চৌধুরী, মানিক, চকলেট, নাইম ওয়াসিম, তারেকসহ কয়েকজনকে একসঙ্গে দেখতে পাই। তামিম, সরোয়ারকে কিছু গ্রেনেড সংগ্রহ করতে বলে। চকলেট, নাইমকে অস্ত্র সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন।

গান্ধী আরও বলেন, বসুন্ধরার একটি বাসায় তারা আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে ঢুকে বেশ কিছু ব্যক্তিকে আমি দেখতে পাই। মানিক, তানভির, কাদেরীসহ গুলশান হলি আর্টিজানে নিহত ৫ জনকে আমি দেখতে পাই। একদিন পরে মারজান বসুন্ধরার বাসায় আসে। হলি আর্টিজানের হামলার নিহত তিনজন আমার রুমে থাকতো।

হামলার জন্য যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা সেগুলো সংগ্রহ করে ওই বাসায় নিয়ে আসে। কোথাও হামলা করা হবে জানতাম তবে কোথায় তা জানতাম না।

২০১৬ সালের ২৭ জুন জানতে পারি তামিম চৌধুরী হামলার স্থান দেখে এসেছেন। এর কয়েকদিন পর তামিম চৌধুরী আমাকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলেন।

তার আগে তামিম জানান, ১ জুলাই সন্ধ্যা ৮টার সময় ঢাকায় হামলা করা হবে। কোথায় হামলা করা হবে সে কথা গোপন রাখার নির্দেশ রয়েছে বলে জানায় সে। তামিম আরও বলেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনারা যেখানে বাসা নিয়েছেন চলে যান। তখন আমি বাসার উদ্দেশে রওনা দেয়। তামিম চৌধুরী অ্যাপসের মাধ্যমে হামলার আপডেট জানান। হামলায় দলের যারা নিহত হয়েছেন তারা যেন শহীদের মর্যাদা পায় বলেও জানান।

৩ জুলাই তামিম চৌধুরী পুনরায় ঢাকা মিরপুরে ১০ নম্বরে ডাকে আমাকে। ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বিভিন্ন জায়গা রেকি (আক্রমণপূর্ব পর্যবেক্ষণ) করতে বলে। ১০ জুলাই উত্তরবঙ্গের দাওয়াত বিভাগের প্রধান রজবকে কল্যাণপুর রিসিভ করতে গিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কাছে ধরা খায়।

রাজীব গান্ধী বলেন, ওই দিন থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তারা আমাকে গ্রেফতারের বিষয়টি গোপন রাখে। ওরা আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিয়েছে। যারা এ হামলার সঙ্গে জড়িত না তাদেরও আমার মাধ্যমে জড়ানো হয়েছে। এখন যাদের এ মামলার আসামি করা হয়েছে তারা কেউ হলি আর্টিজান হামলার সঙ্গে জড়িত নয়। এদের কাউকে আমি কখনও দেখিনি।

এভাবে আসামি রাজীব গান্ধী হলি আর্টিজান হামলায় নিজেকে না জড়ালেও অন্যান্য খুন ও গুলশানের একটি স্থানে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। একইসঙ্গে অপর আসামিদের বাঁচাতে তাদেরকে পরিকল্পনার কোনো পর্যায়ে কিংবা হামলার বিষয়ে না জড়িয়ে তাদেরকে চিনেন না মর্মে বক্তব্য দিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন। বাঁচাতে চেয়েছিলেন অপর জঙ্গিদের।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রায় ৮ আসামির ৭ জনকে ফাঁসির দণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এক আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর