দুই হাজার উনিশ সালের জুলাইয়ের ঘটনা। বর্ষায় সুন্দরবনের রূপ দেখার জন্য দশজনের টিমে ছোট্ট লঞ্চ ‘এম বি গাংচিল’-এ ওঠেছি মংলা জেটি থেকে। সকালে মেঘলা আকাশ মাথায় নিয়ে দুপুর নাগাদ হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে পৌঁছুলাম। ঘন্টাখানেক ঘোরাফেরার পর যখন লঞ্চে উঠব এমন সময় দু-তিন ফোঁটা বৃষ্টির পানি মাথায় এসে পড়ল। তবে সেই অর্থে বৃষ্টি হলো না। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কটকটার উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছাড়ল। লঞ্চ উল্টো দিকে ঘুরে জয়মনির গোল হয়ে শেলা নদী দিয়ে কটকায় যখন পৌঁছুল তখন সন্ধ্যা হয় হয়।
সুন্দরবন অভিযানের দ্বিতীয় দিন সকালের হালকা রোদের আলোয় কটকা টাওয়ারের প্রায় পঞ্চাশ গজ সামনে একটি ঝুনঝুনি বা বন অতসী গাছে সুন্দরী বায়স (সুন্দরবন ক্রো) নামের মহাবিপন্ন এক প্রজাপতির ছবি তুলছিলাম। ছবি তুলতে তুলতে উড়ন্ত পতঙ্গটির পিছু পিছু আমরা ক’জন বনের এতটাই গহীনে চলে গেলাম যে সুন্দরবনের স¤্রাটের কথা মাথায়ই এল না। প্রজাপতিটির প্রজনন ক্ষেত্র আর আমাদের জাতীয় পশু সুন্দরবনের স¤্রাট রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাংলা বাঘের বাড়ি যে একই জায়গায় তা ছবি তোলায় মশগুল আমরা ক’জন খেয়ালই করিনি। অথচ এর আগে যতবার কটকা এসেছি, সবসময় স্থানটি এড়িয়ে চলেছি। সেকারণেই দেশের সবচেয়ে বিরল ও মহাবিপন্ন সুন্দরী বায়স বা সুন্দরবন ক্রো প্রজাপতির প্রজনন ক্ষেত্রটিও কখনও দেখিনি। বিশ্বের আর কোথাও এই প্রজাপতিটিকে দেখা যায় না।
সেদিন সুন্দরবনের সম্রাটের বাড়িতে যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঝুনঝুনি বাগানে মহাবিপন্ন পতঙ্গটির মেলা বসেছে যেন! মহা আনন্দে যখন ছবি তুলছিলাম, তখন আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণের গাইড ফেমাস ট্যুর বিডির কর্ণধার তানজির হোসেন রুবেল কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল এক ঝলকের জন্য সে ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী নাজিম সুন্দরবনের সম্রাটকে হেঁটে যেতে দেখেছে। রক্ত হিম করা এ সংবাদে মুহূর্তেই প্রজাপতির প্রাকৃতিক বাগান মানবশূণ্য হয়ে পড়ল। সবাই প্রাণ হাতে নিয়ে দ্রুত ঘাটে বাঁধা ইঞ্জিন নৌকার দিকে ছুটলাম কটকা অফিসের পাশে নোঙর করা ছোট্ট লঞ্চ ‘এম বি গাংচিল’-এ ওঠার জন্য। সেদিন লঞ্চের প্রায় সকলেই বাঘ আতঙ্কে ছিলাম। এরপরও দুপুরে ভয়ে ভয়ে কটকা থেকে জামতলী সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত একবার ঘুরে এসেছিলাম, তবে সম্রাটের কোনো হদিস পাইনি।
গত আটাশ বছর ধরে নিয়মিত সুন্দরবন যাচ্ছি প্রকৃতি-পাখি-প্রজাপতি-বন্যপ্রাণী দেখতে ও ওদের ছবি তুলতে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির বিরল ও দুর্লভ পাখি-প্রাণীর প্রচুর ছবি তুলতে পারলেও পায়ের ছাপ ও মল ছাড়া বাঘ মামার কোন ছবি তুলতে সক্ষম হইনি। বেশ কয়েকবার সম্রাটের বেশ কাছাকাছি থেকেও তাকে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি, ছবি তোলা তো দূরের কথা। একবার বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালীতে এক বাঘিনীর গর্জন শুনেছিলাম। দু’বছর আগে বাঘের খোঁজে পাঁচদিন সুন্দরবন ঘুরে ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফিরলাম। এর ঠিক একমাস পর আমাদের টিম সুন্দরবনের হোমরা বা সুন্দরী খালে গাছের ডালে বসা এক বাঘের দেখা পেল। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় ধরে তারা ওর ছবি তুলল। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিন আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম না।
তবে, বার বার সুন্দরবন গিয়ে ছবি তুলতে ব্যর্থ হলেও ভারতের ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’ আমাকে হতাশ করেনি। ওখানে পরপর দুদিন দুটি আলাদা স্থানে গিয়ে দুটি ভিন্ন বাঘের দেখা পেয়েছি ও চমৎকার সব ছবি তুলেছি। সুন্দরবনে না দেখলেও রণথামভোরে বাঘ দেখে আমি তৃপ্ত একারণে যে, ওখানকার ও আমাদের সুন্দরবনের বাঘ জিনগতভাবে সবচেয়ে কাছাকাছি। বিশ্বের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সমন্বয়ে সম্পন্ন এক গবেষণার ফলাফলে জিনগতভাবে রণথামবোরের বাঘের সঙ্গেই সুন্দরবনের বাঘের সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া গেছে। এবার রণথামভোরের বাংলা বাঘ দেখার সে গল্পই বলছি।
ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালের ঘটনা। ছয় জনের টিমে মারুতি জিপসি গাড়িতে ভারতের রাজস্থানের সারিস্কা টাইগার রিজার্ভে ঘুরছি রয়েল বেঙ্গল বা বাংলা বাঘের সন্ধানে। এই সংরক্ষিত এলাকাটি রাজস্থানের আলওয়ার জেলায় অবস্থিত। ৮৮১ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল বনটি কাঁটাওয়ালা শুষ্ক জঙ্গল, শুষ্ক পর্ণমোচী, তৃণভূমি ও পাথুরে পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। একসময় এটি আলওয়ার রাজ্যের শিকারের ক্ষেত্র ছিল যা ১৯৫৮ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এখানে ২০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাস। তবে, সারাদিন ধরে বিশাল বনের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি দেখলেও বাঘের কোন চিহ্ন দেখলাম না। বিফল মনোরথ হয়ে জয়পুর শহরে ফেরত এলাম।
পরদিন সকালে জয়পুর থেকে সাওয়াই মধুপুর শহরের দিকে রওয়ানা হলাম। উদ্দেশ্য ওখানকার বিখ্যাত ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’-এ রণথামভোরের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খোঁজ করা। এখানকার বাঘরা এ নামেই পরিচিত। দুপুরে রণথামভোর প্যালেস হোটেলে পৌঁছে ব্যাগপত্র রেখে লাঞ্চ না সেরেই ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’-এর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ক্যানটার-এ (ছাদখোলা ২০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাক) ওঠলাম। ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ (মারুতি জিপসি) জোগাড় না হওয়ায় বিশজনের সঙ্গে বাধ্য হয়েই ক্যান্টারে করে পার্কে ঢুকলাম। এত মানুষের সঙ্গে যে কি বাঘ দেখব সে চিন্তায়ই মন ভেঙ্গে পড়ল।
ক্যানটার এগিয়ে চলল। নানা ধরনের পাখি-প্রাণীর দেখা পাচ্ছি। কিন্তু, ছবি তোলায় মনোনিবেশ করতে পারছি না। এত কষ্ট করে এত দূর এসেও যদি রণথামভোরের রাজার দেখা না পাই তাহলে এ দুঃখ কোথায় রাখব? ক্যান্টরে ঘুরছি প্রায় ঘন্টা দেড়েক হলো। এরমধ্যে রাজার কোন গন্ধও পাচ্ছি না। ধরেই নিয়েছি আজ দেখা হবে না। কাল সকালে জিপসি পাব। কাজেই কালকের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে। এমন সময় ফিরতি পথে আসা একটি জিপসির গাইড বলল বেশ কিছুটা সামনে ওরা মামার দেখা পেয়েছে। এটা শোনামাত্রই ড্রাইভার দ্রুত ক্যান্টর ছোটাল। পনের মিনিটের মধ্যেই আমরা জায়গামতো পৌঁছে গেলাম।
প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনের প্রথম মামার দেখা পেয়ে ক্যানটারের সবাই বেশ উত্তেজিত। ওখানে আরও ৪-৫টি ক্যান্টর-জিপসি দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের সামনে একটা ছোট খাল। সেই খালের মাঝে পাথর খ-ের উপর একটি ছোট কুমির বসে আছে। তারপর এক চিলতে জমি। ওখানে ৩-৪টি তিতির খাবার খাচ্ছে। তারও খানিকটা উপরে শুকনো ঘাসের উপর রাজকীয় ভঙ্গিতে রণথামভোরের রাজা বসে আছে। যাক, অবশেষে রাজার দেখা পেলাম। জীবনে এই প্রথম বনের খোলা প্রান্তরে সত্যিাকরের বুনো বাংলা বাঘ দেখলাম, গত সাতাশ বছর সুন্দরবন ঘুরেও যার দেখা পাইনি। বিকেলের হালকা রোদে মনপ্রাণ ভরে মামার ছবি তুললাম।
পরদিন ভোরে কনকনে শীতে আবারও ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’-এ ঢুকলাম ৬ জনের টিমে জিপসি করে। মামার খোঁজে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরির পর একটি পয়েন্টে গিয়ে ৪-৫টি জিপসি একত্রিত হলো। সবাই বলাবলি করছে আশেপাশে কোথাও মামা লুকিয়ে আছেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না। পাশেই একটি পুরনো একতলা বিল্ডিং। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর শেষমেষ বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠার অনুমতি মিলল। ছাদে ইতোমধ্যেই ভিড় লেগে গেছে। লম্বা লেন্সের ক্যামেরা হাতে ছাদভর্তি ব্যাঘ্র আলোকচিত্রীদের ভিড় বাড়তে লাগল। শেষ পযর্ন্ত বহু কষ্টে ছাদের একপাশে দাঁড়ানোর মতো একটা জায়গা পেলাম। যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে দেহটাকে যতটা বাইরের দিকে বাঁকোনো যায় বাঁকিয়ে ১৫০-৬০০ মিমি লেন্স মামার দিকে তাক করলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। সকালের তীক্ষ্ণ রোদে মামার ঝলমলে সোনালি-হলুদ বর্ণের উপর কালো ডোরা চোখে পড়ল। আর যায় কোথায়, শাটারে ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। এই বাঘটির চাহনি গতকালেরটির থেকেও রাজকীয়! রণথামভোরের রাজার চমৎকার কিছু ছবি তুলে জিপসি চেপে ফিরতি পথ ধরলাম।
আসছে ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস বা আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস। বাঘ সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর দিনটি পালন করা হয়। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে এই দিবসটির সূচনা হয়। সে সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের মূখ্য উদ্দেশ্য বাঘের প্রাকৃতিক আবাসভূমি রক্ষা ও বাঘ সংরক্ষণের জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে বাঘ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা ও ভীতি দূর করা। বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু হওয়ায় এই দিবসের গুরুত্ব এদেশে অনেক বেশি। একসময় সারাদেশজুড়ে বাঘের উপস্থিতি থাকলেও বর্তমানে বাঘ এদেশে অত্যন্ত বিরল ও মহাবিপন্ন প্রাণী ও বিশ্বব্যাপী বিপন্ন বলে স্বীকৃত।
আগে সারাদেশের বনজঙ্গলে বাঘ বাস করলেও পঞ্চাশের দশকের পর এদেরকে সুন্দরবন ছাড়া দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় নি। সর্বশেষ ১৯৬২ সালে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় শেষ গ্রামীণ বনের বাঘটি মারার পর এদেশের গ্রামে আর কোন বাঘ দেখার রেকর্ড নেই। বাংলাদেশে সর্বমোট কতগুলো বাঘ আছে এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন সময় এদেশের সুন্দরবনে বাঘ শুমারির মাধ্যমে ৩০০-৫০০টি বাঘের উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ক্যামেরাট্র্যাপভিত্তিক বাঘ শুমারিতে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘের অস্তিত্ব ধরা পড়ে, যা ২০১৮ সালের শুমারিতে ৮% বেড়ে ১১৪টি হয়। এটিই এখন এদেশের বাঘের সর্বমোট সংখ্যা। তবে, আগের তুলনায় ইদানিং সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা। কারণ, গত দু’বছর ধরে প্রায়ই বাঘ সুন্দরবন ভ্রমণকারীদের নজরে আসছে। সূত্র মতে, বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের আরেকটি ক্যামেরাভিত্তিক শুমারি চলমান যার ফলাফল ২০১৪ সালের ২৯ জুলাই জনসমক্ষে প্রকাশ করবে বাংলাদেশ বন বিভাগ। তবে আশার কথা, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা, যেমন- কাসালং রিজার্ভ ফরেস্ট ও সাঙ্গু-মাতামুহুরি অভয়াণ্য এবং সিলেট বিভাগের ভারতীয় সীমান্তবর্তী পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টে বাঘের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বাঘ এদেশে ব্যাঘ্র বা বাঘ মামা নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম Tiger বা Bengal Tiger। সুন্দরনের বাঘকে Royal Bengal Tiger বলেই ডাকা হয়, যা বৃটিশদের দেয়া। ফ্যালিডি গোত্রের সদস্য বাঘের বিজ্ঞানভিত্তিক নাম Panthera tigris। পৃথিবীতে বাঘের একটিই প্রজাতি। যদিও ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীরা বাঘকে ৮টি (তিনটি বিলুপ্তসহ) উপপ্রজাতিতে বিভক্ত করেছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি দুটি উপপ্রজাতিতে পুনঃশ্রেণিভুক্ত করেছেন, যেমন- মহাদেশীয় (Continental- Panthera tigris tigris) ও সুন্দা (Sunda- Panthera tigris sondaica) বাঘ। মহাদেশীয উপপ্রজাতিটিকে এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে পাওয়া যায়, যা বাংলা, মালয়ান, ইন্দোচীনা, আমুর, ক্যাস্পিয়ান (বিলুপ্ত) এবং দক্ষিণ চীনা (কার্যকরীভাবে বিলুপ্ত) বাঘের জনসংখ্যা নিয়ে গঠিত। অন্যদিকে, সুন্দা উপপ্রজাতিটিকে (যা একসময় ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যেত), শুধুমাত্র সুমাত্রায় পাওয়া যায় এবং জাভা ও বালিতে বসবাসকারীগুলো বর্তমানে বিলুপ্ত।
সুন্দরবনের বাঘকে ঘিরে রয়েছে নানা গল্প, কিংবদন্তী বা মিথ (Myth)। বনের বাওয়ালি (অর্থাৎ কাঠুরে), মৌয়াল (বা মধু সংগ্রহকারী), জেলে ও আশেপাশের এলাকার লোকদের ধারণা বাঘের নাম মুখে নিলে তাকে অপমান করা হয়; এতে তাদের অমঙ্গল হবে। তাই বিভিন্ন বিশ্বাস মতে এর বিভিন্ন নাম রয়েছে। বড় মামা, বড় শিয়াল, বনরাজা, বড়কর্তা, বড় সাহেব, গাজী ঠাকুর, বড় পাইক এসবই বাঘের এক একটি নাম।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বেঙ্গল টাইগার বিড়াল পরিবারের প্রাণী। বিজ্ঞানীদের মতে বাংলা বাঘ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ১২,০০০ বছর আগে আবির্ভূত হয়। বাঘের পূর্বপুরুষের নাম খড়গ-দাঁতি বা তলোয়ার-দাঁতি বাঘ (Saber-toothed tiger)। এদের উপরের চোয়ালের ছেদন দাঁত দুটো দেখতে তলোয়ারের মতো ছিল যা দিয়ে সহজেই শিকারকে বিদ্ধ করা যেত। তারপর অনেক বছর গড়িয়ে গেছে। উপরের চোয়ালের ছেদন দাঁত ছোট হয়ে বর্তমান আকারে এসেছে। উৎপত্তি হয়েছে বর্তমানকালের বাঘ প্রজাতির। এরপর উৎপত্তি হয়েছে বাঘের দুটি উপপ্রজাতি ও জনসংখ্যাগুলো; অবশ্য ইতোমধ্যে কোন কোনটি হারিয়েও গেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাঘের শিকার ঘায়েল করার ক্ষমতা কিন্তু কমেনি এতটুকুও। তবে কোনো কারণে বাঘ এই দাঁত হারালে আর স্বাভাবিক নিয়মে শিকার করতে পারে না। জীবনরক্ষার জন্য তাকে বেছে নিতে হয় ভিন্ন পথ। যাক সে কথায় পরে আসছি।
বাঘ সবচেয়ে বড় বিড়ালজাতীয় প্রাণী। লেজবাদে দেহের দৈর্ঘ্য ১৪০-২৮০ সেন্টিমিটার (সেমি), লেজ ৬০-১১০ সেমি ও উচ্চতা ৯৫-১১০ সেমি। বাংলাদেশের জাতীয় পশুর দেহের লোম সোনালি বা কমলা ও তাতে চওড়া কালো ডোরা থাকে। দেহতলের মূল রং সাদা। লম্বা লেজটিতে থাকে কালো ডোরা। পুরুষের মাথার দুপাশে থাকে লম্বা লোম। চোখ অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশাল আকারের মাথাটা গোলাকার। ১৮০-২৮০ কেজি ওজনের বাঘ মামা অত্যন্ত শক্তিশালী। নিজের থেকে দু’তিনগুণ বেশি ওজনের পশু শিকার করে অনায়াসেই টেনে নিয়ে যেতে পারে।
সুন্দরবনের সম্রাট বাঘ নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা আর নিঃসঙ্গতা পছন্দ করে। তাছাড়া সে চলেও একা। দক্ষ সাঁতারুও বটে। মল-মূত্রের মাধ্যমে নিজের বিচরণ এলাকা চিহ্নিত করে। এই গন্ধ পেলে অন্য কোনো বাঘ সেখানে যায় না। তাছাড়া তার নির্দিষ্ট এলাকায় অন্য কোনো বাঘকে সে বরদাস্তও করে না। মূত্র ছাড়াও বাঘ গাছের বাকল আচঁড়েও নিজের সীমানা নির্ধারণ করতে পারে। বাদাবন, চিরসবুজ ও কনিফার বন, শুষ্ক কণ্টকময় বন, উঁচু ঘাসবন ইত্যাদি এলাকায় বাঘ বাস করে। দিনে কাঁটায় ভরা হেতাল গাছের আড়ালে শুয়ে থাকে। নদী বা খালের পাড়ে জন্মানো অত্যন্ত ঘন গোলপাতার বনও মামার প্রিয় জায়গা। বাঘ যেমন হিংস্র তেমনি বুদ্ধিমানও বটে। সাধারণত ভোরবেলা ও সন্ধ্যায় শিকারে বের হয়; কখনও কখনও রাতে। মামা শিকারও করে একা, আর ভোজও সাড়ে একা।
চিত্রা হরিণ, বুনো শুয়োর, বানর, সজারু, গিরগিটি, বড় পাখি ইত্যাদি প্রিয় খাবার। তবে খাদ্যের অভাবে মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদিও খায়। তবে এরা কিন্তু জন্মসূত্রে মানুষখেকো হয় না। বরং মানুষকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে শক্তি কমে এলে, কোনো কারণে আহত হলে (সজারুর কাঁটায় আহত হওয়াটা সচরাচর দেখা যায়), ছেদন দাঁত বা কুকুর দাঁত ভেঙ্গে গেলে, জেলে-বাওয়ালি, বাজ-ঈগল-বানরের অত্যাচারে, মৌমাছির হুলের জ্বালায় এদের মাথা ঠিক থাকে না। আর তখনই মানুষকে আক্রমণ করে। অনেক সময় বনের চরে কবর দেয়া মৃত জেলে-বাওয়ালির মাংস খেয়েও মানুষের নোনা মাংসের স্বাদ পায় যা আর কোনদিন ভুলতে পারে না। ফলে পরিণত হয় মানুষখেকোতে। সন্তানহারা বাঘিনীও রাগে-দুঃখে, প্রতিহিংসায় মানুষখেকো হতে পারে। আবার মানুষখোকো বাঘিনীর শিকার করা নরমাংস খেয়ে বাচ্চারাও যে নোনা স্বাদ পায় তার ফলে বড় হয়ে মানুষখেকোতে পরিণত হতে পারে।
মামা কখনোই পিছু হটতে জানে না। একবার কোনো শিকারকে তাক করলে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। তবে, ব্যর্থতার বিন্দুমাত্র আশংকা থাকলে সেই শিকার ধরা থেকে বিরত থাকে। আবার নতুন করে পজিশন নেয়। শিকারের জন্য দেড়-দুই কিলোমিটার চওড়া নদীও পার হতে পারে। মামা কোনো শিকারকেই সামনের দিক থেকে ধরে না। পেছন থেকে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়াই তার স্বভাব। তাছাড়া বাতাসের বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ করে বলে শিকার বাঘের গন্ধ টের পায় না। দেহ বিশাল হলেও শিকার ধরার মুহূর্তে তা কুঞ্চিত করে ছোট করে ফেলে। মাটিতে কয়েকবার লেজ দিয়ে আঘাত করে। পায়ের থাবায় লুকানো নখ বের করে আনে। লেজ পাকিয়ে খাড়া করে নেয়। পায়ের তলায় নরম মাংসপিন্ড থাকায় শিকারের একবারে আগ মুহূর্তেও কোনো শব্দই হয় না। এরপর হঠাৎ করেই বিশাল এক হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের উপর। শিকার ধরে তাতে দাঁত বসিয়ে টেনে শ’খানেক মিটার দূরে নিয়ে যায়। সেখানেই ভূড়িভোজ সারে। ভোজশেষে পেটপুরে পানি পান করে। তারপর দেয় লম্বা ঘুম। ভোজ একবারে শেষ করেতে না পারলে তা মাটি, পাতা দিয়ে লুকিয়ে রাখে ও অন্য সময় খায়। একবারে প্রায় ২৫-৩০ কেজি মাংস খেতে পারে। সুন্দরবনের সৌন্দর্য রয়েল বেঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পচাব্দী গাজীর নাম। সুন্দরবনের এই কৃতি সন্তান প্রায় ষাটটি বাঘ শিকার করেছেন, যার বেশিরভাগই ছিল মানুষখেকো।
বাঘ বছরের যে কোনো সময়ই প্রজনন করতে পারে। এ সময় মামার গগনবিদারী বা আকাশ কাঁপানো হুংকার শোনা যায়। সে হুংকারে কেঁপে ওঠে বন-জঙ্গল, খাল-নদী আর বনের পশু-পাখি। বাঘিনী ১০৪-১০৬ দিন গর্ভধারণের পর ৩-৫টি অন্ধ বাচ্চার জন্ম দেয়। এ সময় সে অত্যন্ত নিরিবিলি জায়গায় আশ্রয় নেয়। আমাদের মধ্যে একটি ধারনা প্রচলিত আছে যে, পুরুষ বাঘ বাচ্চাদের খেয়ে ফেলে, তাই বাঘের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাঘিনী সতর্কতার সাথে বাচ্চাদের রক্ষা করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ঠিক নয়। কারণ পুরুষ বাঘ কখনোই তার ঔরশজাত বাচ্চাকে খায় না, বরং রক্ষা করে। তবে, সে অন্য বাঘের বাচ্চা খায়। আর একারণেই জন্মানোর পর অর্ধেক বাচ্চাও বড় হতে পারে না। বাচ্চাহারা বাঘিনী অত্যন্ত হিংস্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। জন্মের প্রায় দশ দিন পর বাচ্চাদের চোখ ফোটে। এরা প্রায় আট সপ্তাহ মায়ের দুধ পান করে। এরপর মায়ের শিকার করা খাবারে মুখ লাগায়। ধীরে ধীরে মায়ের কাছ থেকে শিকার করা শেখে। বাঘিনী এক-দেড় বছর বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখে। আর আড়াই-তিন বছর বয়সে যখন দ্বিতীয়বার এদের দাঁত গজায় তখন থেকেই এরা পুরোপুরি স্বাধীন। আর মায়ের সঙ্গে থাকে না। পুরুষ বাচ্চা ৪-৫ ও স্ত্রী ৩-৪ বছরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। এরা দু’তিন বছরে একবারমাত্র প্রজনন করে। বাঘ ১৫-২০ বছর বাঁচে।
একটি কথা জেনে রাখা ভালো। আমাদের দেশের চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কগুলোতে যেসব রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে তার একটিও কিন্তু আমাদের সুন্দরবনের নয়, বরং সবগুলোই এসেছে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক থেকে। যদিও ভারতীয় সুন্দরবন, রণথামভোর, সারিস্কা ও অন্যান্য কয়েকটি এলাকার বাঘের সঙ্গে বাংলাদেশের বাঘের খুব মিল, কিন্তু অন্যান্য এলাকার বাঘের সঙ্গে জিনগত পার্থক্য দেখা যায়। সূত্র মতে, বর্তমানে যদিও এদেশের বাঘ রক্ষার জন্য বেশকিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে, তথাপি এদেশের গৌরব সুন্দরবনের সম্রাট চোরা শিকারিদের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। কাজেই এ ব্যাপারে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; অন্যথায় একদিন হয়ত সুন্দরবনের সম্রাট ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ চিরতরে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে। সেটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।