দুইদিন আগে কানাডায় এক বাংলাদেশি আপু সুইসাইড করলেন দুটো ছোটো বাচ্চা রেখে। তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ছিলেন এবং ফেসবুক দেখলে আপাতঃ দৃষ্টিতে তাকে অত্যন্ত সুখী মানুষের তালিকাতেই ফেলা যেতো!
এখন প্রশ্ন হলো এরকম একজন মানুষ কেনো নিজের জীবনের এভাবে পরিসমাপ্তি ঘটাবেন? উত্তরটা হয়তো জটিল মানসিক ব্যাধি ‘ডিপ্রেশন’! কিন্তু এই ডিপ্রেশন তো একদিনে কারো মনে বাসা বাধে না, দীর্ঘদিনের প্রচন্ড মানসিক চাপের কারণে মানুষ এমন একটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় যে, তার কাছে তখন মৃত্যুই সবকিছু থেকে পালিয়ে যাবার একমাত্র উপায় বলে মনে হয়।
কিন্তু কেনো এতটা মানসিক চাপে একজন মানুষকে থাকতে হবে? কেনো সে তার একটাই জীবনকে তার নিজের ইচ্ছে মতো সাজাতে বা উপভোগ করতে পারবে না? তার উত্তর হলো সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, নিজের উচ্চাকাঙ্খা এবং সাহসের অভাব।
গবেষণায় দেখা গেছে মৃত্যু পথযাত্রী বয়োঃবৃদ্ধ মানুষের সবারই জীবন নিয়ে কিছু common উপলব্ধি এবং আফসোস থাকে। সেগুলো হলো:
১. বেশিরভাগ মানুষই নিজের জীবনকে সমাজের ইচ্ছায় পরিচালিত করে। পাছে লোকে কিছু বলে, এই ভয়ে নিজের মনের অনেক ইচ্ছাই মানুষ পূরণ করতে পারে না এবং এমন সব সম্পর্কে থেকে যায় অথবা জীবনের ডিসিশন নেয় যা তার জন্যে নিত্যদিনের অত্যাচার স্বরূপ।এবং সমাজকে সুখী করতে গিয়ে নিজে সারাজীবন অসুখী একটা জীবনে সুখী হবার অভিনয় করে কাটিয়ে দেয় আর ভিতরে ভিতরে বাড়তে থাকে অশান্তি!
২. সমাজের চোখে successful হবার জন্যে মানুষ unrealistic target set করে যেটা achieve করতে তার জীবনের ছোটো ছোট আনন্দ গুলো sacrifice করতে হয়। মানুষ মনে করে আরো কিছু টাকা ব্যাংকে জমা করে নেই তারপর enjoy করবো। কিম্তু বাস্তব হলো time flies! কাজেই যখন তার ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমে যায় তখন আর জীবনকে উপভোগ করার মতো শারীরিক বা মানসিক শক্তি তার আর থাকে না।
৩. বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর সময় বেশিরভাগ মানুষই বের করতে পারে না! আবার অনেকের হয়তো অনেক বন্ধু, তাদের সাথে অনেক দেখা সাক্ষাৎও হয় কিন্তু মনের কথা খুলে বলার মতো সত্যিকার বন্ধুত্ব তৈরী হয় না! একটা মানুষযে ভেতরে ভেতরে এতো অশান্তিতে আছে সেটা যদি সে তার বন্ধুকে খুলে বলতেই না পারলো তাহলে সেই বন্ধুত্ব অযথা সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না! এরকম ১০ টা বন্ধু থাকার চেয়ে মনের কথা খুলে বলতে পাড়ার মতো একটা বন্ধু জীবনে থাকলেও সেই মানুষটা অনেক ভাগ্যবান।
৪. অনেকেই দেখা যায় একা থাকার ভয়ে অথবা স্বল্প পরিচয়ে পরিবারের চাপে বিয়ে করে এবং বিয়ের পরে বুঝতে পারে যে এই মানুষটার সাথে সারাজীবন কাটানো তার পক্ষে কঠিন! কারণ প্রচণ্ড ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে বিবাহিত জীবনে যে পরিমান sacrifice করতে হয় উভয় পক্ষকে, সেটা করা কঠিন আর এই পরিস্থিতি তৈরী করে মানসিক চাপ! তখন সমাজের চোখে ভালো থাকার জন্যে মানুষ দিনের পর দিন মিত্থ্যে অভিনয় করে যায় সুখী হবার।ফলস্বরূপ মানসিক চাপ বাড়তে থাকে।
৫. অন্যকে অসুখী করার ভয়ে মানুষ নিজের যেটা করা উচিৎ বা বলা উচিৎ সেটা করতে পিছপা হয় অনেক সময়েই। আর এর ফলে তার মনে জমতে থাকে অশান্তি। ফলে মানুষ নিজের বিবেকের কাছে নিজে সৎ ভাবে বাঁচতে পারে না, ভেতরে ভেতরে তৈরি হয় প্রচন্ড মানসিক অশান্তি।
৬. মানুষ নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি গুলো সহজে ভুলতে পারে না, জীবনে নেতিবাচক ঘটনা গুলোকে বার বার মনে করতে থাকে এবং এই অশান্তির চক্র থেকে বের হয়ে আসতে না পেরে জীবনের বাকি সময়গুলোকেও নষ্ট করে দেয়।
আসলে মানুষ ভুলে যায় যে, জীবন একটাই। এজীবনে আমরা একবারই মরবো কিন্তু বাঁচতে পারি প্রতিদিন, যদি একটু সৎ সাহস থাকে। নিজের জীবনটা সমাজের তথাকথিত সমালোচকদের মুখের ধারালো কথার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান! প্রত্যেকের নিজের ভালো থাকার উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিৎ। কারণ নিজে ভালো না থাকলে যতই চেষ্টা করুক না কেন কোনো মানুষ অন্যকে ভালো রাখতে পারে না!
আর নিজে ভালো থাকলে কে আপনাকে কি বললো না বললো তাতে আসলে কিছুই আসে যায় না। কারণ দিনশেষে এটা আপনার জীবন ! আপনাকে যারা সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে তারা সবসময় আপনি যেটায় ভালো থাকবেন তাতেই সুখী হবে। আর যারা আপনাকে ভালোবাসে না, তাদের মুখ বন্ধ করতে নিজের জীবনটা নষ্ট করা কি চরম বোকামি নয় ? অতএব, ডিপ্রেশনকে না বলুন এবং 'Lets wake up, live your life and sing the melody of your soul!'
হাসিন মাহবুব চেরী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাইক্রোবায়োলজিস্ট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক।