স্কুলে পড়ার সময় রবার্ট লি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করতেন, তার সকল সহপাঠী দুপুরের খাবারের অর্ধেক খাবারই ফেলে দিতো। কাউকে খাবার নষ্ট করতে দেখলেই রবার্টের তার বাবা-মা ও বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়তো খুব করে। কোরিয়ান অভিবাসী রবার্টের পুরো পরিবারের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানিয়ে নিতে বেশ অনেকটা সময় প্রয়োজন হয়। শুরুর দিকে অভাব যেন তাদের নিত্য সঙ্গী ছিল। এমনও দিন গিয়েছে যখন পুরো পরিবারকে একবেলা র্যামেন নুডলস খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে।
বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বলে, বাবা-মা তাদের দুই ছেলেকে সবসময় সতর্ক করতেন খাবার নষ্ট না করার বিষয়ে। তারা বলতেন, ‘এটা খুবই খারাপ একটি কাজ’। বাবা-মায়ের এই সতর্কবার্তাটি সবসময় মেনে চলার চেষ্টা করতেন ২৭ বছর বয়সী রবার্ট।
অবশ্যই রবার্ট ও তার পরিবারের আর্থিক সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফিন্যান্স এন্ড অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে পড়ালেখা শুরু করেন রবার্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও ছোটবেলার শিক্ষাকে ভোলেননি তিনি। নিজ তাগিদ থেকেই ক্যাম্পাসের ফুড-রেসকিউ ক্লাব ‘টু বার্ডস ওয়ান স্টোন’ এ অংশ নেন তিনি। এই ক্লাবটি সপ্তাহের পাঁচদিন ক্যাম্পাসের হলের বেঁচে যাওয়া বিভিন্ন খাবার সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের গৃহহীন মানুষদের মাঝে বিতরণ করতো।
এই ক্লাবে কাজ করার মাঝেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কলেজ আন্ট্রাপ্রেনারশীপ কন্টেস্ট’ এর আয়োজন হয়। এই কন্টেস্টে রবার্ট তার ক্লাবের সহকর্মী লোজিয়া চ্যানের সঙ্গে অংশগ্রহন করেন। কন্টেস্টে তারা ফুড-রেস্কিউ ননপ্রোফিট গ্রুপের থেকে কিছুটা পরিবর্তিত একটি আইডিয়া পরিবেশন করেন। আইডিয়াটা ছিল, বেঁচে যাওয়া খাবার যত কম পরিমাণই হোক না কেন, তাদের প্রতিষ্ঠান সেটা সংগ্রহ করবে এবং সপ্তাহের সাতদিনই খাবার সংগ্রহ ও দুঃস্থদের মাঝে বিতরণের কাজ করা হব। এই সকল কার্যক্রম পরিচালিত হবে স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে।
তাদের এই চমৎকার আইডিয়াটি খুব সহজেই কন্টেস্টে পুরষ্কার জিতে নেয়। পুরষ্কারের ১ হাজার ডলার নিয়েই ২০১৩ সালের জুলাইয়ে রবার্ট শুরু করেন তাদের প্রতিষ্ঠান রেসকিউইং লেফটওভার কুইজিং (RLC). তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করার প্রথম সপ্তাহেই, ২০ জন দরিদ্র মানুষকে খাবার দিতে পেরেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি।
সময় গড়াতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব শেষ করে ওয়াল স্ট্রিটের জে.পি. মর্গানে অ্যানালিস্ট হিসেবে যোগদান করেন রবার্ট। তবে আরএলসির কার্যকর্ম কিন্তু থেমে থাকেনি। অফিসের পরে যতটুকু অবসর সময় থাকতো, পুরো সময় জুড়েই তিনি তার প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে কাজ করতেন।
রবার্ট ও তার প্রতিষ্ঠানের একাগ্রতা ও পরিশ্রমের ফলাফল স্বরূপ স্টারবাকস ও পানেরা ব্রেডের মত পৃথিবী বিখ্যাত ফুড চেইন শপগুলো তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এরপর দেশটির গণমাধ্যমে তাদের কার্যক্রম প্রকাশিত হলে পোর্টল্যান্ড, ওরিগন, ওয়াশিংটন ও ডিসি থেকে রবার্টের কাছে পার্টনারশীপের আবেদন আসতে থাকে।
আরএলসির কার্যক্রম শুরু হবার দুই বছরের মাঝে ২৫০,০০০ পাউন্ডেরও বেশি খাবার বিতরণ করে এই প্রতিষ্ঠানটি।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আরএলসিতে আরো বেশি সময় দেবার জন্য, চাকরি শুরু করার এক বছরের মাঝেই ছয় ডিজিটের স্যালারির চাকরিটি ছেড়ে দেন রবার্ট। তিনি বলেন, ‘চাকরিতে এক ঘন্টা সময় ব্যয় করা ও আরএলসিতে এক ঘন্টা সময় ব্যয় করার মাঝে তুলনা করে আমি অনেক বড় ধরণের পার্থক্য দেখতে পেয়েছি’।
‘একটি আশ্রয়কেন্দ্র আমাদের জানিয়েছিল, এক সপ্তাহে টানা তিন রাত তাদের কেন্দ্রের প্রায় ৩০০ মানুষের রাতের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের ডোনেশনের মাধ্যমে। এমন বিষয়গুলো আমাকে খুব আনন্দ দেয়। এই ধরণের কাজের জন্যই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি আমি’।
বর্তমানে আমেরিকার ১৬টি শহরে কাজ করছে রবার্টের আরএলসি। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বেঁচে যাওয়া খাবার সংগ্রহ করে অসহায়, দরিদ্র, দুঃস্থ ও গৃহহীনদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে খাবার। ইতিমধ্যে আরো ২০০টি শহর আরএলসির সঙ্গে কাজ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কোন খাবার যেন নষ্ট না হয়, এমন উদ্দেশ্য নিয়েই রবার্ট তার কাজ শুরু করেছিলেন। বলা যেতে পারে, তার সেই উদ্দেশ্যের পথে অনেকটাই সফল হয়েছেন তিনি।