আটা-ময়দা ও চিনির তৈরি রসগোল্লাতে, কখনোই আসল রসগোল্লার স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। এই বিষয়টি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলাম ফরিদপুরের, কমলাপুর তেঁতুলতলার ‘খোকা মিঞার মিষ্টি’ খেয়ে। এক গামলা ভর্তি রসে চুবানো সদ্য চুলা থেকে নামানো গরম মিষ্টির ঘ্রাণ ও স্বাদের কাছে নস্যি শহরের সবচেয়ে দামি মিষ্টিটাও। যদি মনে হয় খুব বেশি বাড়িয়ে বলছি, তবে নিজেই একবার ঘুরে আসতে পারেন প্রখ্যাত এই মিষ্টির দোকানটি থেকে। যেখানে ক্রেতাদের সামনেই মিষ্টি তৈরির প্রস্তুতি থেকে শুরু করে, মিষ্টি তৈরির পুরো প্রক্রিয়া ও বেচাকেনা করা হয়।
দোকান না বলে বরং টং ঘর বললেই ভালো হয়। কারণ খোকা মিঞার মিষ্টির দোকানটিতে নেই কোন চাকচিক্য কিংবা উজ্জ্বলতা। কিন্তু তার জন্য ক্রেতাদের আনাগোনা থেমে নেই মোটেও। দোকানে ঢুকতেই দেখা গেলো দোকানের বামপাশে বিশাল বড় দুইটি চুল্লিতে মিষ্টি তৈরি কাজ করছেন দুইজন। আরেকজন সামলাচ্ছেন ক্রেতাদের।
দোকানের এমাথা ওমাথা ঘুরতে ঘুরতেই তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। জানালেন তার নাম মোঃ রাজীব। বিগত তিন বছর ধরে দোকান দেখভালের কাজ করছেন। প্রয়াত খোকা মিঞার হাতে প্রতিষ্ঠিত দোকানটির নাম হয়েছে তার নামেই। খোকা মিঞার অবর্তমানে তার দুই ছেলে মোঃ আমিন হোসেন ও শহিদুল ইসলাম এবং নাতী অনিক মিলেই দোকান চালাচ্ছেন বলে জানালেন তিনি।
ক্রেতাদের মিষ্টি পরিবেশন করার ফাঁকে রাজীব জানান, কেজি হিসেবে নয় পিস হিসেবে বিক্রি করা হয় মিষ্টি। প্রতি পিস দশ টাকা। কেজি হিসেবে কেন বিক্রি করা হয় না প্রশ্ন করা হলে জানালেন, মিষ্টি রসের জন্য কেজি প্রতি মিষ্টির সংখ্যায় হেরফের হয়। এমনটা যেন না হয় সেজন্যই পিস হিসেবে বিক্রি করা হয় মিষ্টি।
প্রতি পিস মিষ্টি বিক্রির প্রসঙ্গে বেশ গর্ব করে রাজীব জানালেন, একবার অর্ডারে আট হাজার (৮০০০) পিস মিষ্টি বিক্রি হয়েছিল একসাথে। এছাড়া দুই-তিন হাজার পিস মিষ্টি বিক্রি হয় প্রতিদিন। মিষ্টি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে নিয়মিত এক মণ ছানা ও ছয়-সাত মণ দুধ-তেল প্রয়োজন হয়।
কথা বলার মাঝেই বিশাল বড় একটি চুলা থেকে এক গামলা মিষ্টি নামিয়ে রাখা হলো। ততক্ষণে চারপাশে মিষ্টির গন্ধে মম করছে একদম। নতুন মিষ্টির গামলা থেকে তৎক্ষণাৎ দুইটি মিষ্টি আমার সামনে এনে রাখলেন তিনি। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে যে, মিষ্টি থেকে গরম ভাপ বেরোচ্ছে। ছোট এক টুকরো মিষ্টি মুখে দেওয়ার পর বুঝতে পারলাম, কেন অনেকে যেনতেন দোকানের মিষ্টি খেতে পারেন না একদম।
মিষ্টি খাওয়ার সময় একই টেবিলে থাকা একজন ক্রেতার সঙ্গে গল্প করার লোভ সামলাতে পারিনি। আলাপচারিতায় জানলাম নাম পিকলু। তার পাঁচ বছরের মেয়ে সুমাইয়াকে মিষ্টি খাওয়াতে নিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে এই মিষ্টি খেয়েই বড় হয়েছি। এখন আমার মেয়েটাকেও এই মিষ্টিটাই খাওয়াই। ছুটির দিনে ওকে নিয়েই দোকানে চলে আসি গরম গরম মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য’।
মিষ্টি খাওয়ার মাঝেই খোকা মিঞার ছেলে মোঃ আমিন হোসেন দোকানে আসেন। পরিচয় দিয়ে কথা বলা শুরু করলে জানান, ১৯৫০ সালের আগে দোকান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় দুধ চা, পরোটা বিক্রি করা হতো। সময় গড়ালে সেখানে মিষ্টিও যোগ হয়। পরবর্তিতে অন্যান্য আইটেম বাদ দিয়ে শুধু মিষ্টি তৈরি করা শুরু হয়। তিনি আরো জানান, ১৯৯০ সালের পর থেকেই মূলত দোকানের সুনাম ও প্রসার হয়। কোন ধরণের প্রচারনা কিংবা বিজ্ঞাপন নয়, লোক মুখে প্রশংসা থেকেই এই জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসা আরো বড় করার ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাইলে জানালেন, এখনই ব্যবসা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। আরো বড় করলে সামলানো কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই আপাতত তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। এছাড়া তেঁতুলতলার এই একটি দোকান ছাড়া আর কোথাও কোন শাখাও নেই খোকা মিঞার মিষ্টির দোকানের।
কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভান্ডার কিংবা টাঙ্গাইলের চমচমের মতোই বিখ্যাত ফরিদপুর জেলার খোকা মিঞার মিষ্টি। বছরের পর বছর একই রেসিপিতে অভিন্ন স্বাদ ও মানের মিষ্টি তৈরি করে ক্রেতাদের বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রেখেছে এই দোকানটি।
আরো পড়ুন: ‘অসহায়’ অনাথের আচার