'কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মত কেউ বলে না/আয় খুকু আয়…/আয় খুকু আয়…'
চিরসবুজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর শ্রাবস্তী মজুমদারের দ্বৈতকণ্ঠের চিরন্তনী গানটি সবাইকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। বাবা যেন চিরকাল ডাকেন তার সন্তানকে। এ ডাক শাশ্বত। অম্লান। হৃদয় ছোঁয়া।
বাবা দিবসে সন্তান তার জন্মদাতা পিতাকে স্মরণ করে। তাকে নিয়ে বিশেষ করে ভাবে। বিশেষ আয়োজন করে। কিন্তু পিতা? তারতো কোনও সন্তান দিবস নেই। প্রতিটি দিনই তার সন্তান দিবস। প্রতিটি ক্ষণই তার সন্তানকে নিবেদিত। তিনি সন্তানকে নিয়ে সর্বক্ষণ ভাবেন, যেমন ভাবেন জননী তার সন্তানের জন্য।
একটি কথা আছে, পিতা না হলে পিতার মর্যাদা ও পিতৃত্বের গভীরতা প্রবলভাবে টের পাওয়া যায় না। মানুষ যখন সন্তান জন্ম দিয়ে নিজে পিতা হয়, তখন অনুভব করে পিতৃত্বের অপত্য স্নেহ। নিজের সন্তানকে সামনে রেখে তখনই অনুভব করা যায়, আমার পিতা আমার জন্য কেমন গভীর টান, স্নেহ, মায়া, মমতা, আবেগ ও ভালোবাসা অনুভব করেছেন বা করেন।
পিতা আসলেই সন্তানের জীবনে ছায়া। বটবৃক্ষের মতো নির্ভরশীল আশ্রয়। সাহসের বরাভয়। ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের নিশানা।
আমাদের প্রাচ্য বা এশীয় দেশগুলোতে পিতা বা মাতা নিয়ে যে চেতনা সন্তানদের মধ্যে জাগরূক হয়, পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয় দেশে তেমনভাবে হয় না। অতি আধুনিক, যান্ত্রিক, দ্রুতলয় সমাজে ব্যক্তি মানুষের এতো সময় ও ভাবালুতা নেই ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার। জীবন সেখানে বড়ই নির্মম, কঠিন, দ্বন্দ্বমুখর ও প্রতিযোগিতা প্রবণ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে ব্যক্তি এতই ব্যস্ত যে বৃহত্তর পরিবার তথা বাবা, মায়ের খোঁজ নিতেও পারে না।
ফলে সেসব দেশে একান্নবর্তী পরিবার বিলোপ হয়েছে। প্রবল ব্যক্তিসত্তা বিকশিত হয়ে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার অবকাশ লুপ্ত হয়েছে। বাবা, মা বাধ্য হয়ে শেষ জীবন কাটাচ্ছেন একাকী ঘরে কিংবা ওল্ডহোমের নিঃসঙ্গতায়। বৃদ্ধাশ্রমই হয় গেছে তাদের স্থায়ী ঠিকানা, যেখানে কালে-ভদ্রে বা কোনও উৎসব উপলক্ষ 'হাই ড্যাড' লেখা সন্তানের পোস্টকার্ড আসে।
সেই চিঠির স্পর্শে আবেগতাড়িত পিতামাতার দিন কাটে। চিঠি বুকে গোপন অশ্রুপাত করেন তারা। প্রত্যাশা করেন সন্তানের সান্নিধ্য। কিন্তু ব্যস্ত সন্তান ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আসতে পারে না। অপেক্ষার নীল বেদনায় কেটে যায় তাদের জীবনের শেষ দিনগুলো।
আমাদের দেশে, এশীয় সমাজে এতোটা কঠিন বাস্তবতা এখনো আসে নি। হয়ত অতি-প্রতিযোগিতার অনাগত দিনগুলো আমাদেরকেও ফেলে দেবে ব্যস্ততার চক্করে। তার আগেই যতটুকু সম্ভব পিতৃসান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করাই উচিত।
গানে নয়, মর্মের গভীর থেকে বাবা যে, আয় খুকু কিংবা আয় খোকা বলে নিত্য ডাকছেন, তা যেন আমরা শুনতে পাই। ছুটে যাই তাদের কাছে। অথবা তাদেরকে রাখি নৈকট্যের নিবিড়তায়। অন্তরের অন্তঃস্থলে।