কাঁধের ব্যথা নিয়ে রোগীরা যা বলছে-
*** ব্যথার মাত্রা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং একসময় তা অসহনীয় হয়ে পড়ে। কাঁধের নড়াচড়াও অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
***ব্যথাযুক্ত পাশে ঘুমাতে গেলে কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ব্যথায় ঘুম ভাঙার পর পুনরায় ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করেও অনেকে তা পারে না। প্রথম দিকে ব্যথা অল্প হলেও তা ক্রমান্বয়ে বাড়ে।
*** কোনো জিনিস হাতে ওঠাতে গেলে, হাত দিয়ে কোন কাজকর্ম করা, রান্নার কাজ ও পরিষ্কার পরিচছন্নতার কাজ করতে গেলে ব্যথা হয় কিংবা ব্যথা বেড়ে যায় কিংবা কাজের পর বিশ্রামের সময় ব্যথা বাড়তে থাকে।
ব্যথার কারণে যে সকল প্রাত্যহিক কাজে ভীষণ অসুবিধা হয় যেমন -
***পিঠে হাত নেওয়া, চুল ব্রাশ করা, জামা পরা, দাঁত ব্রাশ করা, পিছনের পকেটে হাত দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে যায়।
***এমনকি ব্যথাযুক্ত হাত দিয়ে খাবার মুখে দিতেও ভীষণ কষ্ট, আর বগলের নিচ এবং বাম হাত হলে প্রস্রাব– পায়খানার স্থান পরিষ্কার করা যে কঠিন কষ্টসাধ্য বিষয় তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানতে পারেন, বুঝতে পারেন।
কাঁধে ব্যথার কারণ
# নানাবিধ কারণে কাঁধের ব্যথা হয় কিন্তু কাঁধের ব্যথায় শুধু ফ্রোজেন শোল্ডার মনে করাটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
# ফ্রোজেন শোল্ডার মুলত কাঁধের জয়েন্টগুলোর ক্যাপসুলে প্রদাহজনিত কারণে ব্যথা, স্টিফনেস বা জমাটবদ্ধতা।
# কিন্তু কাঁধের মধ্যে তো জয়েন্ট ছাড়াও আরও অনেক ধরনের স্ট্রাকচার –যেমন টেন্ডন, মাসল, বার্সা, লিগামেন্ট, জয়েন্ট কারটিলেজ এ সমস্যাজনিত কারণে কাঁধের ব্যথা হতে পারে ।
# স্পোর্টস ইনজুরি জনিত কিংবা পড়ে গিয়ে বা আঘাতজনিত কারণে কাঁধে ব্যথা দেখা যায় ।
# আবার কারও কারও ক্ষেত্রে ঘাড় থেকে স্নায়ুজনিত কাঁধে ব্যথা আসতে পারে।
# অনেক ক্ষেত্রে অর্থপেডিক সার্জারির পরবর্তীতে কাঁধে ব্যথা, স্টিফনেস, দুর্বলতা দেখা যায়।
# স্ট্রোক জনিত কারণে ও কার্ডিয়াক সার্জারি পরবর্তীও কাঁধে ব্যথা হতে পারে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিত্তথলির প্রদাহ, যক্ষ্মা, ফুসফুসে ক্যান্সার জনিত কারণেও কাঁধে ব্যথা হতে পারে ।
# রিউমাটোয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলজিং স্পোনডাইলাইটিস আছে—এ ধরনের রোগীরা এই ব্যথাগুলো বেশি নিয়ে আসে।
# ডায়াবেটিস, হাইপারলিপিডেমিয়া বা শরীরে অতিরিক্ত মেদ, হাইপার থাইরয়েড, হৃদরোগ ও প্যারালাইসিস রোগীদের কাঁধে ব্যথা বেশি দেখা যায়।
# তা ছাড়া যাদের বয়স ৪০ বছরের ওপরে, তাদের ক্ষেত্রেও এটি বেশি দেখা যায়।
রোগীর কাছ থেকে কাঁধের ব্যথার বিস্তারিত শুনে বিভিন্ন রকম ফিজিক্যাল এসেসমেন্ট এর মাধ্যমে কাঁধের ব্যথার কারণ প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। ফ্রোজেন শোল্ডারের রোগী নিজে এবং অন্যের সহযোগিতায় কোনোভাবেই হাত ওঠাতে পারে না। অন্যান্য কারণের জন্য হলে অন্যের সহযোগিতায় হাত ওঠাতে পারে। তবে প্রয়োজনে রক্তের কিছু পরীক্ষা, এক্স রে, এম আর আই কিংবা মাসল আল্ট্রাসাউন্ড করে সমস্যা সম্পর্কে পুরাপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়।
চিকিৎসা – কাঁধের ব্যথার আল্টিমেইট চিকিৎসা ফিজিওথেরাপি!
কাঁধের ব্যথার চিকিৎসা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ব্যথার কারণের নির্ণয় এর ওপর । যেমন ফ্রোজেন শোল্ডার হলে চিকিৎসা একরকম আবার শোল্ডার এর টেন্ডনাইটিস, বারসাইটিস, লিগামেন্ট ইনজুরি, ইন্সটেবিলিটিসহ অন্যান্য সমস্যায় চিকিৎসা সম্পূর্ণ অন্যরকম। তবে সাধারণত ব্যথা কমানোর জন্য হালকা কিছু ব্যথানাশক, কাঁধের অস্থিসন্ধিতে স্টেরয়েড ইনজেকশন দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়- যদিও এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক। বিশেষ করে টেন্ডন ও লিগামেন্টে কোনভাবেই স্টেরয়েড দেওয়া ঠিক না কারণ এতে টেন্ডন ও লিগামেন্টের ইনজুরি বেড়ে গিয়ে ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। আবার সঠিকভাবে এই ইনজেকশন দিতে না পারলে হাত অবশ হয়ে যেতে পারে বা শুকিয়ে যেতে পারে।
কাঁধের ব্যথার সাথে মেকানিক্যাল বিষয়সমূহ সরাসরি যুক্ত। তাই কাঁধের ব্যথার কারণ নির্ণয় ও যথাযথ সঠিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য বিশেষজ্ঞদেরকে কাঁধের পেথমেকানিক্স জানতে হয়। পেথমেকানিক্স জানতে হলে কাঁধের বায়োমেকানিক্স, মুভমেন্ট সাইন্স, স্ট্রাকচারাল ও ফাংশনাল এনাটমি জানতে ও বুঝতে হয়। আর এসকল বিষয়সমূহ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের শিখতে হয়, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। তাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরা অতি অল্প সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে ব্যথামুক্ত করে কর্মক্ষম জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।
কাঁধে ব্যথা হলে নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করতে পারেন –
***যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন ভাল দক্ষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা শুরু করুন। এই ক্ষেত্রে যত দেরি করবেন– কাঁধের সমস্যা ও জটিলতা তত বাড়বে।
***হাত কে অ্যাক্টিভ রেস্টে রাখতে হবে এবং যতটা সম্ভব স্বাভবিক জীবনযাপন করতে হবে এবং সচল থাকতে হবে।
***যেসব কারণে ব্যথা বাড়ে কিছুদিনের জন্য সেগুলো কমিয়ে ফেলতে হবে কিংবা এড়িয়ে চলতে হবে। আর যেভাবে হাত রাখলে ব্যথা কম লাগে, সেভাবে রাখার চেষ্টা করুন।
***ব্যথার স্থানে ব্যথার ধরণ ও কারণ অনুযায়ী ব্যথার ক্রিম লাগিয়ে সুতার তোয়ালে দিয়ে ২০ মিনিট গরম সেক ও ১০ মিনিট ঠাণ্ডা পানির সেক দিনে ৩ থেকে ৪ বার দিতে পারেন । অথবা প্রয়োজনে শুধু গরম বা ঠাণ্ডা পানির সেক দিতে পারেন ।
***প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ গুলো নিয়মিত করুন। সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যয়ামগুলি নিরূপণের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে সঠিকভাবে করতে পারেন। থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ ভুল হলে আপনার ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
***সাধারণ মানের ব্যথার ওষুধ খেতে পারেন, তারমধ্যে প্যারাসিটামলই সবচেয়ে ভালো, প্রয়োজনে ব্যথানাশক ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন।
ডা. দলিলুর রহমান, এম এস ফিজিও (অস্ট্রেলিয়া), সহযোগী অধ্যাপক, এন আই পি এস, কলকাতা, সিনিয়র কনসালটেন্ট, কেয়ার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পেইন, ফিজিওথেরাপি এন্ড স্পোর্টস ইনজুরি বিশেষজ্ঞ।