কামাল তো আব্বাকে আব্বা বলে ডাকারই সুযোগ পায়নি: প্রধানমন্ত্রী

, জাতীয়

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-28 21:06:05

নিজের ছোট ভাই শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন উপলক্ষে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্না করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আব্বা তো বেশিরভাগই জেলে থাকতেন এবং কামাল জন্মের পর থেকে বেশিরভাগই জেলখানায়। কামাল তো আব্বাকে আব্বা বলে ডাকারই সুযোগ পায়নি। এক সাথে যখন খেলতাম আমি আব্বা বলে যখন ডাকতাম ও আমাকে জিজ্ঞেস করতো হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। একথা বলে কান্না করেন প্রধানমন্ত্রী।

বুধবার (০৫ আগস্ট) দুপুরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অডিটোরিয়ামে শহীদ কামালের বর্ণাঢ্য কর্মবহুল জীবনের ওপর ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সেই ভার্চুয়াল আলোচনায় গণভবন থেকে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এ কথাগুলো বলেন।

ভাই শেখ কামালের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই আমি আর রেহেনা যখন বাংলাদেশ থেকে জার্মানের উদ্দেশে রওয়ানা হই। কামাল তখন মাত্র বিয়ে করেছে, একেবারে নতুন বউ। আমি কামালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাদের জন্য কি নিয়ে আসবো? আমার একটা ডায়েরি ছিল সেই ডায়েরিতে কামাল লেখে দিল ‘এডিডাস বুট’ নিয়ে আসবা আমার খেলোয়াড়দের জন্য। আমি বললাম লিখে দাও সে লিখে দিলো। সেই লেখাটা রয়ে গেছে। আমি তখন বলেছিলাম এতোগুলো প্লেয়ারের জন্য কি করে বুট নিয়ে আসবো। কামাল বলেছিল তুমি একটু চেষ্ট করে নিয়ে আসবে। সে নিজের জন্য কোনো দিন কিছু চাইত না।

তিনি বলেন, লেখাপড়া, খেলাধুলা বা নাট্যচর্চা সবকিছুতেই তার অনবদ্য অবদান ছিল। তার নাটক আমি নিজে দেখতে গেছি। বিভিন্ন সময় উপস্থিত বক্তৃতা, সবখানে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতো। দেশের জন্য দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য বিশেষ করে বাঙালি জাতির জন্য আমার বাবা যেভাবে সারাজীবন উৎসর্গ করে গেছেন আমরা ভাই-বোনরা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সবাই বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, আমাদের সেই সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমার মা সব সময় আমাদের লেখাপড়া সবদিকে নজর দিতেন। ছোট্টবেলা থেকেই কামাল শুধু খেলাধুলা নয় সাংসারিক কাজেও মাকে সহযোগিতা করতেন। ছোট্ট বয়স থেকে খুব দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতেন। আজ কামাল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আজকে তার সৃষ্টি আবহানী ক্লাব এখনো আছে। আজ যদি বেঁচে থাকতো দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত। সত্যিকার অর্থে আমার জন্যও ভালো হতো।

কিন্তু এভাবে একদিনে সবাইকে হারাবো এটা কখনই চিন্তাও করতে পারিনি । ১৫ আগস্ট কি ঘটেছে? কামাল মুক্তিযোদ্ধা। সেনাবাহিনীর কমিশনড অফিসার ছিল। শেখ জামালও মুক্তিযোদ্ধা সে সেনাবাহিনীর একজন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার। আমার চাচা শেখ আবু নাসের মুক্তিযোদ্ধা, শেখ ফজলুল হক মনি মুক্তিযোদ্ধা, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক ছিলেন।কামাল যাদের সঙ্গে কাজ করেছে তাদের হাতেই নিহত হতে হলো আমাদের পরিবারের সকল সদস্যকে। কি নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আব্বা দেশ শুধু স্বাধীনই করেননি। তিনি তো এই সেনাবাহিনী গড়েও তুলেছেন। যারা আমাদের বাড়িতে রীতিমত আসা-যাওয়া করত। আমাদের বাড়িতে নাস্তা ভাত খায়নি এরকম কেউ নাই। আর তারাই যখন সরাসরি কামালের সামনে এসে কামালকে গুলি করে বা জামালকে গুলি করে বা বাড়িতে গুলি করল একবার চিন্তা করে দেখেন। একটা মৃত্যু হলে তার বিচার দাবি করে আমার কাছে, আমি কিন্তু বিচার পাইনি। আমরা বিদেশে ছিলাম আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। আমাদের দেশে ফিরতে বাঁধা দেওয়া হয়েছে।

 তিনি বলেন, দেশে যখন ফিরলাম, আমি মামলাও করতে পারিনি। কারণ মামলা করার অধিকার ছিল না। আইন করে বন্ধ করা হয়েছিল যে মামলা করতে পারব না। ২১ বছর পর সরকারে এসে তারপর মামলা করে বিচার করি। কাজেই যখন বিচার চান তখন এটাই মনে হয় আমাদের তো কত বছর লেগেছে এই বিচার করতে। একজন রাষ্ট্রপতি যিনি দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন তার জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়েছেন দেশের জন্য যার সারাটা জীবন কারাগারে কেটেছে। সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তার পাশে থেকে শক্তি সাহস জুগিয়েছিলেন আমার মা যার কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না। তিনি নিজের জীবনের জন্য কিছুই চাননি। তিনিও সব সময় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আজকে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের সামরিক কর্মকর্তারা মেজরের ওপরে উঠতে পারেনি। এখন জেনারেল হচ্ছে লেফটেনেন্ট জেনারেল হচ্ছে এটা কেন হতে পারল, হতে পারল দেশ স্বাধীন করার জন্য। আব্বা নিজের হাতেই পদোন্নতি দিয়ে গেছেন। মেজর জিয়াকে মেজর থেকে মেজর জেনারেল সেই পদোন্নতিটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই দিয়েছিলেন। সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যার হাতে গড়া তাকেই হত্যা করে দিয়ে ঠিক যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সেই চেতনাটাই নষ্ট করতে চেয়েছিল। কত নির্মমভাবে হত্যা। রাসেল একটা ছোট ১০ বছরের শিশু তার কি অপরাধ। আরিফ সেও সমবয়সী। সুকান্তর বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর তাকেও হত্যা করা হয়েছে। একটা স্বাধীন দেশ, সেই স্বাধীন দেশেই হত্যাকাণ্ড হয়েছিল।

দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্যায়, অবিচারের প্রতিকার করার, হত্যার বিচার করার সুযোগ পেয়েছি। দিনের পর দিন আমাদের কাঁদতে হয়েছে। আজকে কামাল নেই। আমাদের এক সাথে ওঠাবসা, খেলাধুলা। এক সাথে চলাফেরা, ঝগড়াঝাটি। এক সাথে সাইকেল চালানো এক সাথে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলা যেহেতু আমরা দুই ভাইবোন কাছাকাছি। আমি যখন বিদেশে গেলাম। ১৯৬৯ সালে আব্বা মুক্তি পাবার পর কামালের কথাই আমার সব থেকে বেশি মনে হতো। আমরা এতো বেশি মাকে ঘিরে আব্বাকে ঘিরে ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে ওদের ছেড়ে যেকোনো দিন থাকতে হবে ভাবতেই পারিনি। কামালের  এত বহুমুখী প্রতিভা। কামাল প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে তো কিছুই করেনি। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর