করোনায় রক্ষা, না হলে লোডশেডিং হতে পারতো: পিডিবি চেয়ারম্যান

, জাতীয়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 14:40:24

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদের চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় শান্তিতে আছি, ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা হলে, লোডশেডিয়ের প্রশ্ন আসতেই পারতো। যদি তাত্বিকভাবে বলি তাহলে বলবো কোনো রিজার্ভ মার্জিন নেই।’

শুক্রবার (১৪ আগস্ট) বিকেলে অ্যানার্জি অ্যান্ড পাওয়ার আয়োজিত ‘বিদ্যুতের বর্ধিত উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা হচ্ছে ২০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। অক্সিলারি কনজামশন ৫ শতাংশের মতো কমলে হয় ১৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। যেকোনো একটি সিস্টেমে প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর থাকে, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয় ৮০ভাগ। সাড়ে ১৯ হাজার মেগাওয়াট থেকে ২০ শতাংশ কমলে, সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট থাকে গ্রিডকে ডেলিভারি দেওয়ার মতো ক্যাপাসিটি। গ্রিডকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য স্পিনিং মার্জিনে রাখতে হয়। ১০শতাংশ মার্জিন রাখলে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এবছর কিন্তু চাহিদা ফোরকাস্ট করা হয়েছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট।’

তিনি আরও বলেন, ‘জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। আমাদের গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১১হাজার মেগাওয়াট। ১৫০০ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছি ১২০০ এমএমসিএফডি। যা দিয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতে পারি। প্রায় ২৫ শতাংশ গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকছে। গ্যাস থেকে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৮২৫০ মেগাওয়াটের মতো।’

চেয়ারম্যান বলেন, ‘তেল ভিত্তিক রয়েছে ৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এরমধ্যে ৩২শ মেগাওয়াট বৃবহৃত হচ্ছে। বাড়তি থাকলো ৩২’শ মেগাওয়াট। গ্যাসের কারণে উৎপাদন ঘাটতি মিটাপ করলে বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা থাকে মাত্র ৮’শ মেগাওয়াট। এতো বড় সিস্টেমে কি ৮’শ মেগাওয়ার্ট খুব বেশি। এটা হয়তো এটাকে আপনি অতিরিক্ত বলবেন।’

তিনি বলেন,, ‘আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা যদি বেশি হতো, যদি ম্যাক্সিমাম গ্যাস পেতাম। গ্যাসের উৎপাদন ও আমদানি চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে ৩২০০ মেগাওয়াট হাতে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর জরুরি প্রয়োজন ছিল। এটা নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ নেই। বিদ্যুতের বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের এসব ডাটা বিশ্লেষণ করার অনুরোধ করছি।’

বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী বলেছেন প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ১৭ হাজার প্লাস, এটি কতটুকু সারপ্লাস? ইকোনমিক জোনগুলো যেভাবে দ্রুত হচ্ছিল, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ১৫ হাজার প্লাস দাঁড়াতো। এটাকে যদি বিবেচনায় নেন, তাহলে ঠু মাচ।’

তিনি আরও বলেন, ‘জার্মানিতে রিজার্ভ মার্জিন কোনো কোনো সময়ে শত ভাগ। ভারতের রিজার্ভ মার্জিন ৭০ ভাগের মতো। তারা দিনের বেলা সোলারে চালায়। আমাদের এখানে অস্বাভাবিক বা অপরিকল্পিত কিছু হয়নি। কোভিডের কারণে চাহিদা কমেছে, মাস্টারপ্লান রিভিউ করছি। বিদ্যুতের লোডশেডিং সংক্রান্ত বিষয় আমাদের আগাম জানানো উচিত, কোনো কোনো জায়গায় মাইকিং করি। বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা গ্রাম-গঞ্জে কি অবস্থায় রয়েছে আপনারা অনেকে ভালো জানেন। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে কাজ করছি।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সূফী বলেন, ‘জ্বালানি তেল থেকে সরে আসতে হবে। বর্তমান জেনারেশন ক্যাপাসিটি যদি বলি সঠিক রয়েছে। আজকে গ্যাস সেক্টর উন্নত হয়নি। সেই ব্যর্থতার দায় বিদ্যুৎ নেবে কেনো। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যদি আমলা নির্ভর বেশি হয়, স্বাস্থ্যখাতের মতো অবস্থা হতে পারে। বিদ্যুৎ খাত একশ মিটার গতিকে দৌড়াচ্ছে। জ্বালানি খাত ৫০ মিটার গতিতে দৌড়াচ্ছে। পেট্রোবাংলার ব্যর্থতার জন্য আজকের এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।’

ড. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সরকারি বিভিন্ন প্রচারণাতে হাইলাইট করতে গিয়ে। রিয়েল ক্যাপাসিটি বলা হয় নি। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করা হয়েছে। কয়লা আমদানি করার ক্ষেত্রে কোনো লিমিটেশন নেই, কিন্তু দেশিয় কয়লার কথা বলা হলেই নানা রকম মন্তব্য। আমরা কি বাস্তবভিত্তিক প্লান করি, নাকি ফরমায়েশি প্ল্যান করি।’

বাংলাদেশ ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার এসোসিয়েশন (বিপপা) প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, ‘কোভিডকালীন সময় না হলে, হয়তো হাজার থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াটের লোডশেডিং দেখতে পেতাম। প্রয়োজনের নিরিখে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আমরাও চাইনা পিডিবি চাপে থাকুক। সরকার লিকুইড ফুয়েল পর‌্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেবে, এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। পাবলিক সেক্টরের অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’

আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানির চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘গত দেড় বছর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গ্যাস না থাকলে সেখানে নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পেমেন্ট ভিত্তিতে তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নবায়ন হতে পারে। গ্যাসের ক্রাইসিস রয়েছে আমাদের গ্যাস পাওয়ার কথা ১৪ থেকে ১৫০০ এমএমসিএফডি। আমরা ম্যাক্সিমাম পেয়েছি ১২০০ এমএসসিএফডি। ক্যাপটিভের গ্যাস পিডিবিকে দিলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সহজ হতো।’

অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘আমাদের যে গ্রোথ দায় কোভিডের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া যায়। কোভিডের আগেই চাহিদা কমে গেছে। শিল্পে চাহিদা বাড়েনি। ৩ বছর ধরে চাহিদা বাড়ছে না।, কতোদিন আবাসিকে ভর করবেন। ২০২০ এরপর দেখতে পারবেন ওভার ক্যাপাসিটি কতো দেখতে পাবে। একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছে, ২০৩০ সালের পর বাড়তি ক্যাপাসিটি ৫৮ শতাংশ মতো বাড়তি হবে। দেশের যদি ইকোনমির গ্রোথ না হয়, এটা কার দোষ, পাওয়ার ডিভিশনের দোষ? নেক্সট ইয়ারের ডিমান্ড অ্যানালাইসিস খুব ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। অস্বাভাবিক পরিকল্পনার কারণে আজকে বিদ্যুতের দাম বেশি। ভবিষ্যতেও বেশিই থাকবে।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘পুরো পাওয়ার সেক্টরটাই সমস্যা। সর্বাঙ্গে ব্যাথা ওষুধ দিবো কোথা। ২০১১ সালে যে প্লান করা হয়েছিল। সেই প্লান অনুযায়ী উৎপাদন ক্ষমতা বাড়েনি। তখন তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ নিরোৎসাহিত করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ডিসেম্বরে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে তেল ভিত্তিক ৩১’শ মেগাওয়ার্ট করতে হবে। চাহিদা তাৎক্ষনিকভাবে এটা কোন পরিকল্পনার অংশ ছিল। ওইটাই বজ্রপাত ঘটাইছে বিদ্যুৎ খাতে। পেশাদার পেশাজীবীদের দিয়ে চালানো হোক। ডেপুটেশন বাতিল করা হোক।’

এনার্জিপ্যাকের সিইও হুমায়ুন রশীদ বলেন, ‘আমাদের দেশে যদি এনাফ থাকে। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারিরা আগ্রহী হবে। জেনারেশন হতে হবে আরও বেশি, আগামীতে চাহিদা আরও বেশি বাড়বে। অর্থনৈতিক জোনগুলো আসছে সেখানে অনেক চাহিদা বাড়বে। প্রতিবছর ৩ মিলিয়ন লোক জব মার্কেটে আসছে। সরকার দিতে পারছে মাত্র দেড় মিলিয়নের মতো। এই জব মার্কেট বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি বিদ্যুৎ। এখন সফটওয়ার নির্ভর মেশিন। এগুলো নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ চায়। আমরা কষ্টে আছি, কোয়ালিটি এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের চিন্তা করতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। আর এর জন্য এনার্জি এন্ড পাওয়ারের নিরাপত্তা জরুরি। এখানে যদি ব্যর্থ হই, তাহলে নতুন প্রজন্মের জন্য নিশ্চিত ভবিষ্যত গঠনে ব্যর্থ হবো। সাপ্লাই চেইনটা আরও দক্ষ করতে হবে।’

সেমিনার পরিচালনা করেন অ্যানার্জি অ্যান্ড পাওয়ারে এডিটর মোল্লাহ আমজাদ হোসেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর