গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে প্রথম দিকে বেশ তোড়জোড় ছিল। এখন যতটা পারা যায় বিলম্বিত করার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিতরণ সংস্থাগুলো। কিন্তু কি কারণে কেনো এই বিপরীতগামী অবস্থান।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এর একটি মাত্র কারণ হতে পারে। প্রথম দিকে তারা মনে করেছিলেন আবাসিকে অনেক বেশি গ্যাস পুড়ছে। মিটার স্থাপন করলে তাদের রাজস্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু লালমাটিয়া (২০১৬ সালে) এলাকায় প্রথম যখন মিটার বসানো হলো তার রেজাল্ট এলো উল্টো। দেখা গেলো প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের বিল আসছে দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা। যাদের মিটার নেই তাদের কাছ থেকে বিল আদায় করা হচ্ছিল দুই চুলা সাড়ে ৪’শ টাকা।
এখন হিসেবে করলে লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে যদি মাসে গড়ে ২’শ টাকা হারে বেশি বিল আদায় করে তাহলে পরিমাণটা কতো দাঁড়ায়। ধারণা করা হয় কয়েক লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলোর কোনো সিস্টেম লস নেই। তাহলে কি করে সম্ভব। সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস একবার সিস্টেম গেইনও ( অর্থাৎ গ্যাস যা কিনেছে তার চেয়ে বেশি বিক্রি করেছে) করেছে। এটি কি করে সম্ভব হয়। আর এই চুরির গ্যাসটাকে ফাঁকির মধ্যে ফেলতেই এই কৌশলী অবস্থান নিয়েছে।
খবর পাওয়া যায় চোরাই লাইনগুলোর সঙ্গে বিতরণ কোম্পানির লোকজনের একটি যোগসাজশ রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট হারে মাসোয়ারা পেয়ে থাকে। সে কারণে চুরি বহাল থাকলে তাদের সুবিধা। আর লোকসান ছাড়া গ্যাস চুরি বহাল রাখতেই এই কৌশলী অবস্থান।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পূর্বে বলেছিলেন, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রীর হিসেব ক্যালকুলেট করলে বৈধ ৩৮ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মাসে সাশ্রয় দাঁড়ায় ১২ কোটি ৫৪ লাখ ঘনমিটার। যার পুরোটাই এখন চোরের পেটে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)২০১৮ সালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের দ্রুত করার আদেশ দেন। কিন্তু কোম্পানিগুলোর ঢিলেমির কারণে গ্রাহক যাতে নিজেরা মার্কেট থেকে মিটার কিনে স্থাপন করতে পারে সেই সুবিধা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে গ্রাহক নিজের পছন্দমতো দোকান থেকে মিটার ক্রয় করে বিতরণ কোম্পানিতে জমা দেবেন। বিতরণ কোম্পানিগুলো পরীক্ষা করে গ্রাহকের আঙ্গিনায় স্থাপন করবে।
নীতিমালার ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে. প্রি-পেইড/স্মার্ট মিটারের স্ট্যান্ডার্ড ও টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন চূড়ান্ত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং মিটার যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কারিগরি কমিটি কাজ করবে। এরপর হিমঘরে চলে গেছে এর কার্যক্রম।
সম্প্রতি বিইআরসি এ সংক্রান্ত অগ্রগতি জানতে চেয়ে পেট্রো বাংলাকে চিঠি দিয়েছে। ১৯ জুলাই ইস্যু করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আবাসিক পর্যায়ে খোলা বাজার থেকে প্রি-পেইড মিটার/ স্মার্ট গ্যাস মিটার ক্রয় স্থাপন নীতিমালা-২০১৯ প্রণয়ন সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কমিশন আশা করছে নীতিমালার আলোকে বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি কমিটি ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিসমূহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বিইআরসি বলেছে, ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর গেজেটে পর্যায়ক্রমে সকল আবাসিকে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয় বিতরণ কোম্পানিগুলোর গৃহীত ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়। নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে বলে কমিশন আশা করে। কমিশন একটি পত্রিকার রিপোর্টের সূত্র চিঠিতে উল্লেখ করেছে, প্রি-পেইড মিটার স্থাপন কাজ শেষ হলে প্রতি চুলায় ৩৩ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হবে। এতে বছরে ৫৩ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হবে, যার বর্তমান বাজার মূল্য ১ হাজার ৯’শ কোটি টাকা। এমতাবস্থায় বিতরণ কোম্পানিসমূহ গৃহীত ব্যবস্থা কমিশনকে অবহিত করা জন্য বলা যাচ্ছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আল-মামুন বলেছেন, প্রথমে সাড়ে ১২ হাজার প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়। এরপর জাইকার সহযোগিতায় আরও দুই লাখ মিটার বসানো হয়েছে। নতুন করে দেড় লাখ স্থাপনের ডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আরও সাড়ে ৪ লাখের একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জ্বালানি দিবসের সেমিনারে বলেছেন, করোনা কিছু ক্ষেত্রে সাপে বর হয়েছে। আমি অনেকদিন ধরেই প্রি-পেইড মিটারের দিকে জোর দিচ্ছিলাম। কিন্তু অনেক কোম্পানির গাছাড়া ভাব। তারা এখন বিল না পাওয়ায় বলছে প্রি-পেইড মিটার ভালো। আমরা চেষ্টা করছি যতো দ্রুত সম্ভব সকল গ্রাহককে প্রি-পেইডের আওতায় আনতে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের এক হিসেবে পেট্রোবাংলার এক তথ্যে দেখা গেছে, গ্যাসের ৪৩ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ২ লাখ ১৩ হাজার প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। চলমান রয়েছে আরও আড়াই লাখ মিটার স্থাপনের কাজ। অন্যরা মাসিক ভিত্তিতে বিল দিয়ে যাচ্ছে। মিটার স্থাপনে ধীরগতিসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন থেকে গ্রাহক চাইলে নিজেরা মিটার কিনে স্থাপন করতে পারবে। কিন্তু নীতিমালার পরও বিষয়টি অনেকটা আড়ালে থেকে গেছে ৯ মাস ধরে।