তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ঘাঘট, করতোয়া ও ব্রহ্মপুত্রসহ রংপুর অঞ্চলে বিভিন্ন নদ-নদীর ৫১৪ কিলোমিটার অববাহিকার বিস্তৃণ জমিতে এবার বন্যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পানিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসেবে, রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলায় আমন, আউশ, পাট, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭৩ কোটি টাকার। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দুই লাখ কৃষক। তবে এই পরিসংখ্যান আরও বেশি হবে বলে মনে করছেন বানভাসি ও ক্ষতিগ্রস্তরা।
চলতি মৌসুমের গেল দুই দফার বন্যায় রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন পানি কমতে শুরু হওয়ায় বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে জেগে উঠেছে বন্যার ক্ষত। কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো এখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনলেও বীজ সংকটে দিশেহারা। আমন আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তাই রয়েছেন বেশির ভাগ কৃষক।
এদিকে বন্যা কবলিত রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চড়া সুদে ঋণ নিয়েও এখন বীজ কিনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু আমনসহ অন্যান্য ফসলের বীজ পাচ্ছেন না প্রান্তিক কৃষকরা। কোথাও বীজ মিললেও দামে মিলছে না। লাগামহীন দাম আর বীজ সংকট দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বন্যায় ক্ষত-বিক্ষত কৃষকরা সরকারিভাবে দ্রুত কৃষি সহায়তাসহ অন্যান্য প্রণোদনা প্রদানের দাবি করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা নদী বিস্তৃত গঙ্গাচড়ার বিনবিনা, চিলাখাল, বাগেরহাট, চরইচলি, জয়রামওঝা, মটুকপুর, চরবাগডোহরা এলাকায় আমনের বীজতলাসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব এলাকায় অনেক কৃষকের আমন চারা বালুতে ঢেকে গেছে। আবার কোথাও চারা ক্ষেত ভেঙে গেছে। বন্যার পানি কমায় কিছু কৃষক বাহির থেকে চারা কিনে রোপন করলেও বেশির ভাগ কৃষক এখনও চারা লাগাতে পারেনি।
রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলার বেশির ভাগ কৃষকের অবস্থা এখন এমনই। বিস্তৃণ মাঠ জুড়ে বন্যার ক্ষত। আমন আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তাই সবচেয়ে বেশি। চড়া সুদে ঋণ নিয়েও মিলছে না বীজ। আবার হাতে বীজ মিললেও দাম যেন লাগামহীন।
গঙ্গাচড়ার চরবাগডোহরা গ্রামের কৃষক শাহিনুর, আব্দুল লতিফ ও দুলাল মিয়া জানান, তাদের সব চারা নষ্ট হয়ে গেছে। চারার অভাবে এখনো তারা জমিতে চারা লাগাতে পারেনি। জমি পতিত পরে আছে।
জয়রামওঝা গ্রামের রজব আলী বলেন, রোয়া গারছি, পানিতো খ্যায়া গেইছে। এখন যে গারমো তার কোনো বুদ্দি নাই। এই সময় তো আর বেচনও নাই। এখন জমি পরি থাকপে। দাম দিয়্যাও এ্যলা বীজ মেলে না।
বিনবিনা চরে কথা হয় কৃষক আনারুল ইসলামের সাথে। চলতি মৌসুমের বন্যায় ফসল হারিয়ে দিশেহারা তিনি। চেষ্টা করছেন ধার-দেনা করে আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর। চোখে মুখে হতাশা নিয়ে এই কৃষক বলেন, লাভের উপর টাকা নিয়্যা আমাক বেচন কিনা লাগবে। কিন্তু বেচন তো পাওয়া যাইতোছে না। যদিও বেচন মেলে দাম অনেক বেশি।
এদিকে ফের বন্যা হলে আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যহত হবার আশঙ্কা করছেন কৃষি বিভাগ। তবে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে শাক ও সবজির বীজ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কৃষি প্রণোদনায় বন্যা কবলিত রংপুর অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনামূল্যে ১৪ ধরনের শাক-সবজির বীজ দেয়া হবে। এছাড়াও রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের লক্ষ্যে বীজতলার বিশাল কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
সরকারি হিসেব মতে, এবারের বন্যায় রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ৬৪৪২ দশমিক ৭৭ হেক্টর জমির পাট, ৩৭৮ দশমিক ৫ হেক্টর জমির তিল, ২০৫ হেক্টর জমির মরিচ, ৩০ দশমিক ৬ হেক্টর জমির চিনা বাদাম, ২০.০০ হেক্টর জমির কাউন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার অনুমানিক মূল্য ১৭২ কোটি ৫৪ লাখ ১১ হাজার ৩৮৪ টাকা। দীর্ঘ স্থায়ী এই বন্যায় পাঁচ জেলায় ১ লাখ ৭২ হাজার ৭৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, ফসলের ফলন ও বাজার মূল্য বিবেচনায় এবারের বন্যার প্রথম ধাপে ১০৩ কোটি এবং পরের ধাপে ৬৯ কোটি টাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রণোদনার মাধ্যমে ক্ষতি পূরণে চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বীজতলার বিশাল কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। সবজি প্যাকেজ দেয়া হচ্ছে। মাসকালাই প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে ভুট্টা, গম, তেল জাতীয় প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে।
অন্যদিকে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক ড. সরওয়ারুল আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের ৩৭ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে শাক ও সবজি বীজ বিতরণের জন্য ১০ কোটি ২৬ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৫ টাকার প্রণোদনা দিয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে রংপুর অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা এই প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ সহায়তা পাবেন।