বাংলাদেশের বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে থাকে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ বন্দরে পণ্য রক্ষণাবেক্ষণে বেহাল দশা, পণ্য খালাস ও পরীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে জটিলতা আর জায়গা সংকটসহ নানা অব্যবস্থাপনায় স্থবির হয়ে পড়েছে বাণিজ্যক কার্যক্রম। এতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের পাশাপাশি বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়েছেন আমদানি পণ্য বহনকারী ভারতীয় ট্রাক চালকরা।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাণিজ্য বাড়াতে বন্দরের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। এসব বাস্তবায়ন হলে বাণিজ্যে গতি ফিরবে বলেও জানান তিনি।
রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) সকালে ভারতীয় ট্রাক চালকদের বাণিজ্য বন্ধের হুমকির বিষয়টি বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছেন বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন।
জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু। এ বন্দর থেকে ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক শহর কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে প্রথম থেকেই এপথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি দুই দেশের ব্যবসায়ীদের। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে বেনাপোল বন্দরে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে আসছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। বার বার রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ীরা সর্বশান্ত হচ্ছেন।
বন্দরে জায়গার অভাবে দিনের পর দিন পণ্য নিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। যার প্রভাব পড়ছে দেশীয় বাজারে আমদানি পণ্যের ওপর। অথচ এ বন্দর থেকে প্রতিবছর সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। ইতিমধ্যে বেনাপোল বন্দরের অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ জানিয়ে ভারতের পেট্রাপোলের বনগাঁ মোটরশ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন আল্টিমেটাম দিয়ে বলেছে, দ্রুত পণ্য খালাসসহ অব্যবস্থানার স্থায়ী সমাধান না আসলে সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) থেকে তারা বেনাপোল বন্দরে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিবেন। এতে দুঃচিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক বলেন, এমনিতেই করোনার কারণে তিন মাস এপথে বাণিজ্য বন্ধ ছিল। আবার যদি আমদানি বন্ধ হয়ে যায় তবে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বেন তারা। তবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দাবিকে সমর্থন করেন তিনি।
সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর ররহমান জানান, সুষ্ঠু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেনাপোল বন্দরে সমস্যার অন্ত নাই। বন্দরের জায়গার অভাব আর খালাসের যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় তারা সময়মতো পণ্য নিতে পারছেন না। অথচ এ বন্দর থেকে প্রতিবছর তারা সরকারকে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিচ্ছেন। নিরাপত্তা সমস্যায় বারবার অগ্নিকাণ্ডে পথে বসছেন ব্যবসায়ীরা। দিনের পর দিন খালাসের অপেক্ষায় ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় আমদানি খরচ বাড়ছে। সন্তোষজনক সমাধানের মাধ্যমে যাতে বাণিজ্য সচল থাকে তার জন্য আলোচনা চলছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ভারতীয়রা বেনাপোল বন্দরের অব্যবস্থাপনায় ক্ষুব্ধ হয়ে এ পথে বাণিজ্য বন্ধের যে হুমকি দিয়েছেন তার যৌক্তিকতা আছে। উন্নয়ন নিয়ে বেনাপোল বন্দরের কোনো মাথা ব্যথা নাই। বন্দরের ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৪০ হাজার মেট্রিক টন কিন্তু পণ্য থাকে সব সময় ২ লাখ মেট্রিক টন।
অবহেলা অযত্ন খোলা আকাশের নিচে এসব পণ্য বৃষ্টির পানি-কাদাতে ভিজে মান নষ্ট হচ্ছে। বারবার বন্দর কর্তৃপক্ষকে বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি জানানো হলেও নজরদারি কম বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে বেনাপোল বন্দরকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার জোর দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট এমপোর্ট-এক্সপোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে বারবার বন্দর কর্তৃপক্ষকে বলা হলেও তাদের উদাসীনতায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। যার খেসারত ভোগ করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সরকারও হারাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব। অথচ যেসব বন্দরে এখনও বাণিজ্য শুরু হয়নি সেখানে উন্নয়ন ও প্রশাসনিক ব্যয় শুরু হয়েছে। কিন্তু বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশের ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের চাহিদা থাকলেও যথাযথ উন্নয়ন নাই। বন্দরের গুরুত্ব বুঝে সরকারকে উন্নয়ন করতে হবে। তবে ভারত অংশে পেট্রাপোল বন্দরে ২০০৮ সালে স্থলবন্দর ঘোষণার পর অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে সেখানে আগামী দুইশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে যেমন আধুনিকমানের সবধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে তেমনি বেড়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রয়েছে এসি ওয়ারহাউজ, সিসি ক্যামেরা, সীমান্তরক্ষী বিএসএফয়ের সশস্ত্র নিরাপত্তা। যার কোনোটাই বেনাপোল বন্দরে নাই বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, উন্নয়ন বাড়াতে হলে বন্দরকে নৌ পরিবহনের অধীন থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে হবে। যা ইতিমধ্যে ভারত সরকার পেট্রাপোল বন্দরে করেছে। বেনাপোল বন্দরের যথাযথ উন্নয়ন করতে হলে দ্রুত নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে হবে।
বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল বলেন, ইতিমধ্যে বন্দরের বেশ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। তবে বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন জায়গা অধিগ্রহণ, পণ্যগার বাড়ানো, চুরি রোধে সিসি ক্যামেরা ও বন্দরের চারপাশে প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।
বন্দরকে নৌ পরিবহনের অধীন থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।
উল্লেখ্য, দেশের চলমান ১২টি বন্দরের সবচেয়ে বড় আর বেশি রাজস্ব দাতা বেনাপোল বন্দর। বাণিজ্যিক দিক থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের পর বেনাপোল বন্দরের অবস্থান। বেনাপোল বন্দরে আমদানি পণ্য রক্ষণাবেক্ষণে বন্দরে ৩২টি ওয়ার হাউজ, একটি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, একটি রফতানি টার্মিনাল ও একটি ভারতীয় চ্যাচিজ রাখার টার্মিনাল রয়েছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।