৪০০ কিন্ডারগার্টেন বন্ধ, বাধ্য হয়ে অটো চালাচ্ছেন শিক্ষকরা!

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2023-08-31 10:17:21

রাজশাহী মহানগরীর নামকরা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক ছিলেন আশরাফুল ইসলাম। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকতা করে আসছেন তিনি। তা দিয়েই রাজশাহী শহরে ভাড়া বাড়িতে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও শিশু সন্তান নিয়ে সংসার চালাতেন আশরাফুল।

তবে করোনাভাইরাসে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বাধ্য হয়ে ভাড়ার অটোরিকশা চালাচ্ছেন তিনি। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর বিনোদপুর বাজারে আলাপ হয় তার সাথে। কথাপোকথনের এক পর্যায়ে জানান গেল কয়েক মাসের দুর্বিষহ জীবনযাপনের কথা।

আশরাফুল বলেন, ‘মার্চের স্কুল বন্ধের পর শুধু ওই মাসের বেতনটা পেয়েছি। এরপর থেকে বেতন বন্ধ। এতদিনে যে টাকা সঞ্চয় করেছিলাম, তা দিয়ে দুই মাস কোনোমতে পার করেছি। কিন্তু জুন থেকে শুরু হয়েছে টানাপোড়ন। বাসা ভাড়া দিতে পারছি না, চাল-ডাল কেনার সামর্থ্যও নেই। এভাবে আর কতদিন? বাধ্য হয়ে ভাড়ার অটো নিয়ে চালাচ্ছি।’

তিনি জানান, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রথম দিকে আবার স্কুল খোলার ব্যাপারে আশ্বস্ত করছিল। আমি ও আমার সহকর্মীরা আশায় ছিলাম। ভাড়া করা ভবনে স্কুল চালাতেন মালিক। ভাড়া পরিশোধে কর্তৃপক্ষও হিমশিম খাচ্ছিলেন। জুলাইয়ে স্কুলের ভাড়া ভবনেই ছেড়ে দিয়েছেন। এখন বলছেন- স্কুল আর চালাবে না মালিক।’

শুধু আশরাফুল নয়, রাজশাহীতে অন্তত ৪শ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের এখন একই দশা। স্কুল বন্ধ হওয়ায় বেকার শিক্ষকরা কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছেন রাস্তায় রাস্তায়। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। সরকারি কোনো অনুদানও পাননি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো অন্তত ৭/৮ জন শিক্ষক জানালেন তারাও অটো চালিয়ে সংসারের খরচ নির্বাহ করছেন। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা বলছেন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো খুলবে, তবে কিন্ডারগার্টেন কবে চালু হবে বা তারা চাকরিতে বহাল হতে পারবে কিনা তা নিয়ে ঢের সংশয়! কারণ অধিকাংশ মালিকপক্ষ এখন স্কুল গুটিয়ে ফেলেছেন।

রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, জেলা মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১ হাজার ৫৮টি। যার মধ্যে কিন্ডারগার্টেন ৪২৪টি। এর মধ্যে রাজশাহী মহানগরীতে ১৩৩টি, গোদাগাড়ী উপজেলায় ৪৫টি, পবায় ৭৩টি, চারঘাটে ২৩টি, তানোরে ১৩টি, দুর্গাপুরে ১৮টি, পুঠিয়ায় ১৮টি, বাগমারায় ৫৪টি, বাঘায় ২৩টি ও মোহনপুরে ২৪টি। এসব কিন্ডারগার্টেনে কমপক্ষে ১২ জন করে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োজিত ছিলেন। অর্থাৎ প্রায় ৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এখন বেকার।

রাজশাহীতে কিন্ডারগার্টেন গুটিয়ে নিচ্ছেন মালিকপক্ষ

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, মার্চ থেকে এসব কিন্ডারগার্টেন বন্ধ রয়েছে। তবে গতমাসের শুরু থেকে হাতে গোনা কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন অনলাইন ক্লাস চালু করেছে। বাকি স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। আমরা তথ্য পাচ্ছি- স্কুল শিক্ষক-কর্মচারীদের অব্যাহতি দিয়ে গুটিয়ে ফেলছেন। কারণ হিসেবে তারা স্কুলের জন্য নেওয়া ভবনের ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন।

রাজশাহী কিন্ডার গার্ডেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম সারোয়ার স্বপন জানান, প্রথম দুই-একমাস রাজশাহীর সব কিন্ডারগার্টেনের মালিকরা শিক্ষকদের বেতন দিয়েছেন। তবে মে মাস থেকে আর কেউ বেতন-ভাতা দিতে পারেন নি। ফান্ড শূন্য হয়ে গেছে। কারণ আয় বন্ধ হলেও স্কুলের ভবন ভাড়া ঠিকই টানতে হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রাজশাহীতে সর্বসাকুল্যে ৫০টি কিন্ডারগার্টেন এখন চালু আছে। বাকিদের অবস্থা খুবই নাজুক। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক স্কুল গুটিয়ে ফেলেছেন। এ বছরের চলতি মাসসহ চার মাস কিন্ডারগার্টেন খোলার সম্ভাবনাই দেখছি না। আর শীতে যদি করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তেই থাকে, তবে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্তও প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। তাহলে কর্তৃপক্ষ কোন আশায় স্কুলের ভবন ভাড়া গুণবে?

রাজশাহী নগরীর ভেড়িপাড়া মোড়ের প্রতিজ্ঞা কিন্ডারগার্টেনের মালিকদের একজন আফজাল হোসেন বলেন, ‘আমরা পুঁজি হারিয়ে ফেলেছি। আয় নেই, অথচ প্রথম দিকে তিনমাস ভবন ভাড়া এবং শিক্ষকদের বেতন টেনেছি। সরকার স্কুল খুলে দিলেও আপাতত আমরা স্কুল চালু করতে পারব না।’

বরেণ্য কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মিজানুর রহমান বলেন, দুইজন শিক্ষক নিয়োগ করেও আমাদের স্কুল চালানোর সক্ষমতা নেই এখন। স্কুলের অভিভাবকদের বলে দিয়েছি- অন্য কোথাও ভর্তি করতে। আগামী বছরেও আমরা শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারব কিনা সন্দেহ!

এ সম্পর্কিত আরও খবর